ঝোরার দেশে পাগলা ঝোরা

স্নিগ্ধা সেন

 

মন ভেসে যায় অনেক দূরে পাহাড়পুরে;

তোমায় আমায় ভাসিয়ে নিয়ে ওই সুদূরে।


 আমরা দুজন বাসিন্দা একেবারে ভিন্ন মেরুর তাইতো লড়াই চলে ছন্দে দ্বন্দ্বে দুলকি চালে,  তবুও আমরা একসাথে হেঁটে চলি বন পেরিয়ে মাঠ পেরিয়ে গিরিকন্দর। সঙ্গে এখন কিঁচিরমিচির একটি চড়াই।

 

 মন পাখিকে ভাসিয়ে দিলাম আকাশে এবার পাড়ি জমাই ওই সুদুরে সবুজ বানানীর কোলে এক টুকরো পাহাড়পুরে। ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে শীতল আবেশ এসে পরশ করে। রেলের কামরায় জানলা দিয়ে সোনা রোদ ঝিল মিলিয়ে ওঠে;  মনের মাঝে বয়ে আনে খুশির জোয়ার।  ট্রেন এসে থামে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে,  গুটি গুটি বেরিয়ে পড়ি

 

প্লাটফর্ম পেরিয়ে, নির্ধারিত গাড়ি অপেক্ষা করে স্টেশন সংলগ্ন প্রাঙ্গণে;  হাসিমুখে এগিয়ে যাওয়া উষ্ণ সম্ভাষন  ভাবের টুকরো টুকরো আদান-প্রদান।  গাড়ি এগিয়ে চলে মাটিগাড়া, সালুগাড়া পেরিয়ে ক্রমশ প্রবেশ করতে থাকে জঙ্গলের মধ্যে যে জঙ্গল বিস্তৃত রয়েছে আসামের কাজিরাঙ্গা পর্যন্ত। এই পথে চলতে গিয়ে ঘিরে ধরে এক নিস্তব্ধতার আবেশ নিবিড় হয়ে ছায়া ঘনায় তরতাজা সবুজ তরু বালকেরা। এই পথেই ইতি উতি দেখা মিলতে পারে এক পাল হাতি অথবা একটা দুটো ভীরু হরিণ শাবকের।  গাড়ি ক্রমশ সমতল পেরিয়ে চড়াই আরোহন। পুবের তিস্তা পশ্চিমে রক্তিম বর্ণের রঙ্গীতের মাঝখানে রয়েছে সিনতাম। আমরা নামচি বাজার পার করে ডান হাতে রাস্তা ধরলাম।  রাস্তা তুলনামূলকভাবে সংকীর্ণ এবং অমসৃণ। এ পথে পার হয়ে যাই অসংখ্য ঝোরা। এক অদ্ভুত ভালো লাগার স্রোত বয়ে চলে মনের মাঝে। পাগলাঝোরারা এসেছে ঝোরার রাজ্যে।  কর্দমাক্ত রাস্তা পেরিয়ে আমরা এলাম সবুজে ছায়া রা বাংলাতে, সময়টা যেহেতু মে জুন মাস তাই চেনা অচেনা ফুলেরা সৃষ্টি করেছে যেন রঙের উৎসব রঙ্গোলি। কতকটা চেনা কতটা একেবারেই অপরিচিত তবুও হাতছানি দেয় আপন করে। ছানা কোলেই কাছে যাই ছুঁয়ে দেখি অনুভবে মিশিয়ে নি। আশ্রয় নিয়েছিলাম পাহাড় আর জঙ্গলের কোলে। এক শান্ত নিরালায় একটি কাঠের দোতলা বাড়ি,  প্রকৃতির সাথে একেবারে মানানসই ; রয়েছে পরিচ্ছন্ন রুচির ছাপ যা বাইরে থেকেই বোঝা যায় ;  রয়েছে প্রকৃতির ছোঁয়া,  প্রবেশের মুখে বাবুই পাখির বাসা ঝুলিয়ে রাখা আছে।  কাছে গিয়ে ছানাকে কোলে নিয়ে ছড়া কাটি "বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই কুঁড়েঘরে থেকে করো শিল্পের বড়াই" শুনেই ছানার হাততালি। এবার কাঠের সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে জিনিসপত্র রেখে নজর পড়ল ওপেন টেরেসে। এক দৌড়ে সেখানে গিয়ে দুই দু হাত দুপাশে সমান্তরাল ভাবে মেলে দিয়ে একটা ডিপ ব্রিদ।  একেবারে বিশুদ্ধ শীতল বাতাসকে ভরে নিলাম অন্তরেতে আমার অনুভূতির মাঝে। তা দেখে ছেলের বাবার  পাগলি  ডাকে আমিও অমনি লাইসেন্স পেয়ে গেলাম আরো পাগলামি করার।  টেরেসে দাঁড়ালেই সামনে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজের হাতছানি। ওক, বাদাম, ম্যাগনোলিয়া আর ফুটে আছে রোডোডেনড্রন ফুলেরা একদম নিবিড় হয়ে রয়েছে পর্বতের ঢালে।  তারও ওপাশে পরিষ্কার আকাশে দেখেছিলাম শয়নরত বুদ্ধকে। এরপর পায়ে পায়ে হেঁটে গেলাম খানিকটা দূর একেবারেই নিরালা এক উপত্যকা। স্বল্প সংখ্যক লোকের বসবাস ; এক অদ্ভুত স্নিগ্ধতা এখানে বিরাজমান।

 

 এরপর ঝুপ করে নামের সন্ধ‍্যা,  আমরাও ফিরি ঘরের কোণে। এখানে বিদ্যুতের ব্যবহার নেই,  হ্যারিকেনের আলোয় সারতে হয় সব কাজ।  রাতের বেলায় এক অন্যরকম বাতাবরণ তৈরি হয়,  চারিদিক ঘন কালো আঁধার যেন কেউ কালি দিয়েছে ঢেলে এমনই নিকষ।  এরই মাঝে হারিকেনের টিমটিমে আলোকে ঘিরে সম্মেলন করে পোকারা একটি দুটি ভাব জমাতে আসে আমাদের সাথে আমি ভয় পাই পাছে কোন পোকা যদি আদর করে দেয় তবেই হবে সর্বনাশ।তাই রাত বাড়তেই মশারির মধ্যে প্রবেশ।

 

 পাহাড়ের সকালের রয়েছে এক ঝকঝকে দিনের আহবান সেই আহবানে কোথাও থাকে না কোন মলিনতা, বাজে না কোন বিষাদের সুর কেবল এক আনন্দের তরঙ্গ হয় প্রবাহিত আর তারই সাথে সঙ্গত দেয় পাখির কল কাকলি।  আমরাও সেই আহ্বানে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম দুজনে টেরেসে। দেখেছিলাম মুগ্ধ হয়ে পর্বতের  শৃঙ্গে দিনের শুভ সূচনা, বার্তা পেয়েছিলাম এগিয়ে চলার।

 

 এরপর আমরা বেরিয়ে পড়লাম অন্যখানে এই যে অন্যখানে যাওয়া এই আমাদের মন্ত্র প্রকৃতির সাথে নিবিড় হওয়ার মান-অভিমান চলতে থাকে তবুও যাত্রী আমরা একই পথের। আমাদের গাড়ি এবার নামচি বাজার পার করে বাঁক নিল ডান দিকে, ধীরে ধীরে আমরা চলি এক ছায়া সুনিবিড়  অন্ধকারাচ্ছন্ন রাস্তা ধরে।  মনে হয় এখানে বহু কাল সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারেনি এমনই গাছেদের লেগে লেগে থাকা।  বামদিকে কেবল কনিফার আর পাইন গাছের সারি বেঁধে থাকা আর মেঘবালিকা একেবারেই হাতের মুঠোয় দিতে চায় ধরা। মাঝে মাঝেই রাস্তায় নেমে আসে অন্ধকার। মেঘ উড়ে আসে গাড়ির জানালা দিয়ে একদম আমার কাছে। ধরতে গেলেই পালিয়ে যেতে চায় তবে ধরেই ফেলি হাতের মধ্যে।  ধরা দেয় বিন্দু বিন্দু জলকণা, মনের মাঝে তখন খুশির হাওয়া বইতে থাকে গান ওঠে গুনগুনিয়ে।

 

 অবশেষে আমরা এসে পৌঁছলাম আমাদের নির্দিষ্ট রিসোর্টে টেমি টি গার্ডেনের ভিতরে চেরি রিসোর্টে। নামের মধ্যেই রয়েছে এক ভালো লাগার আবেশ। গাড়ি থেকে নেমে চা বাগানের মধ্যে দিয়ে গিয়ে পৌঁছলাম রিসার্টে। ঢোকার আগে পথের দুপাশে চেরি গাছ চিনিয়ে দেবে যে আমরা এসে গেছি।  রিসোর্ট এ গিয়ে ঘরে ব্যাগ পত্র রেখে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াতেই পরশ পেলাম এক টুকরো শীতল বাতাসের ; হৃদয় দিয়ে সে ঘ্রান নিলে পাওয়া যাবে চায়ের সুবাস কারণ আমাদের চারপাশ ঘিরে রয়েছে চা বাগান। যতদূর চোখ যায় ধাপে ধাপে থোকা থোকা চা বাগিচা এটাই বিখ্যাত টেমি টি গার্ডেন।  এক ছুট্টে চলে যাই চায়ের রাজ্যে পাতাদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি। ঝকঝকে আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে দুহাত তুলে চিৎকার করে বলতে মন চায় প্রকৃতির কোলে আশ্রয় নিতে চায় এক সবুজ অবুঝ প্রকৃতি কন্যা দিও না তারে দূরে ঠেলে নিবিড় করে নাও গো তারে। সহসা চমক ভাঙ্গে মা ডাকে কোলে তুলে নিয়ে ফিরে আসি

 

ঘরে। এরপর বিকেলে আবার বেরিয়ে পড়া ঘন পাইন গাছের সারি ধরে,  পথ গিয়ে মিশেছে বুদ্ধ পার্কে। অনেকখানি জায়গা জুড়ে রয়েছে একটি পার্ক আর তারই মাঝখানে ধ্যানস্ত মূর্তি অবলকিতেশ্বরের।  ওরই পাদদেশে বসে থাকা যায় অনেকটা সময়। মনে আনে প্রশান্তির বার্তা। এরপর সন্ধ্যা নামার আগেই ফিরে আসা। পরদিন ফিরতে হবে আবার সেই নাগরিক জীবনে। ফেরার পথে অবশ্যই সঙ্গে আনা অপূর্ব স্বাদ ও গন্ধ যুক্ত টেমি টি। বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে অনুভব করি সেই সময়গুলোকে আর চায়ের আমেজে পাই প্রকৃতির সান্নিধ্য।।