লেটো ও ক্ষেন্তি বুড়ি
কালিদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
ইংলিশ হাফপ্যান্ট এই একটাই আছে, বাকি সব দড়ি দেওয়া প্যান্ট। তাই এই প্যান্ট টা কে শুধু ইস্কুল যাওয়ার সময় ই ব্যবহার করে লেটো। কিন্তু ইস্কুল থেকে ফেরার পথে যদি বড় বাইরে পেয়ে যায় তাহলে আর কি করা যাবে! ইংলিশ প্যান্টের মর্যাদা রাখার জন্য ওটাকে উল্টো করে মাথায় পরে নিল সে,অনেকটা খবরের কাগজে ছবি তে বড় বড় হোটেলের শেফ দের মাথায় যেমন টুপি পরা থাকে।
ইস্কুলের ব্যাগ টা ঘোষেদের বাগানের শ্যাওড়া গাছটার নিচু ডালে ঝুলিয়ে রেখে একটু দূরে ঝোপের মধ্যে বসে পড়লো লেটো। কাজ সেরে পাশেই ডোবার জলে জলশৌচ করে উঠে
আসছে কি রাস্তায় রিকশার ওপর রাঙাপিসি , পিশেমশাই , আর টুকুনকে দেখতে পেয়ে গেল, তারপর দৌড়ে এসে রিকশার পেছনের পাতলা রডখানা ধরে ফেলে রিকশার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়, দেখাদেখি টুকুন ও রিকশা থেকে নেমে এসে ওকে অনুকরণ করলে। পিশেমশাই বললে – “লেটো দৌড়াচ্ছিস দৌড়ো কিন্তু পড়ে হাত পা ছড়ে গেলে পিসি আসার আনন্দ মাটি হয়ে যাবে”। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই লেটো রিকশা ছেড়ে আগে দৌড়ে গিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে মাকে সর্বাগ্রে এই খবর টা দেওয়ার গৌরব অর্জন করলে যে রাঙাপিসি, পিশেমশাই, টুকুন সব্বাই আসছে!
মা রান্নাঘর ছেড়ে উঠোনে নেমে এসে বললে – “এসো ঠাকুরজামাই, এসো ঠাকুরঝি, কিন্তু টুকুন কই?”
আর টুকুন! সে তখন কোণের ঘরে ঢুকে দিম্মার গলা পেছন থেকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরে দিম্মাকে চমকে দিয়েছে।
সারাদিন বেশ হই হট্টগোলের মধ্যে কাটলো। টুকুন আর ও দুই পিসতুতো মামাতো ভাই প্রায় সমবয়সী, তবে ও টুকুনের চেয়ে তিন মাসের বড় হলেও টুকুন ওকে লেটো বলে নাম ধরে ডাকে এজন্যই লেটোর খুব রাগ হয়। বিকেলে পাড়ার মাঠে টুকুন কে নিয়ে ফুটবল খেলে এসে কলে হাত পা ধুয়ে বাবার হুকুম মতো একটু পড়তে বসতে গিয়েই ব্যাগের খোঁজ পড়লো।
এই রে! ব্যাগ তো সেই শ্যাওড়া গাছটার ডালে রয়ে গেছে!
লেটো মা কে মিছি করে বললে - “মা, বিজ্ঞান বইটা শুভর কাছে রয়ে গেচে, আমি যাবো আর আসবো”। জবাবে মা কিছু বলার আগেই হাওয়া। ভাগ্যিস আজ চাঁদের আলো আছে, নইলে এই ভর সন্ধ্যেবেলা ঘোষেদের বাগানে ঢুকতে ভয় লাগতো। কিন্তু শ্যাওড়া গাছের ডালে তো ব্যাগ টা নেই! তাহলে গেল কোথায়।
ইস্কুলের ব্যাগ আর কে নেবে? নিশ্চয়ই পচা, কেলো বা শুভর কাজ। ইস্কুল থেকে ফেরার সময় ব্যাগ টা দেখে লুকিয়ে রেখেছে। ওর কাছ থেকে ঝালমুড়ি, ঘুঘনি, ওমলেট এসব আদায়ের তাল। হঠাৎ একটা পাখীর ডাক শুনে ওপরের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল – ওই তো ব্যাগ টা, শ্যাওড়া গাছটার উঁচু ডাল থেকে ঝুলছে । কি আশ্চর্য, ও তো হাতের নাগালে থাকা নিচু ডালটায় ঝুলিয়ে রেখেছিল, ওই ওদেরই কারোর কাজ। যাই হোক শ্যাওড়া তো আর খুব একটা উঁচু গাছ নয়, ও চপ্পল টা খুলে রেখে গাছে উঠে পড়লো ।
ব্যাগ টা হাতে পেতে মিনিট চারেক লাগলো, নামতে গিয়ে চক্ষুস্থির! একি গাছ টা এতো লম্বা হয়ে গেল কি করে! এ যে পাশের তাল গাছটার চেয়ে ও লম্বা হয়ে গেছে! জ্যোৎস্নার আলোয় গাছের নীচে খুলে রাখা চপ্পল টা অনেক নীচে দেখা যাচ্ছে। এতো লম্বা গুঁড়ি বেয়ে নামা ওর কম্মো নয়। লাফিয়ে পড়লেও বাঁচবে না। এখন দরদরিয়ে ঘাম দিচ্ছে লেটোর। সামনের ফাঁকা
জমির ওপর দিয়ে কুঁজো হয়ে, লাঠি হাতে হেঁটে আসছে কে ওটা, পচার ঠাকমা ক্ষেন্তি বুড়ি না? কিন্তু সে তো ছ মাস আগেই মরে গেছে। লেটো গাছের ডাল টা কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। ও জানে এই সময় রাম রাম বললে কাজ হয়। কিন্তু রা – বলতেই গলা শুকিয়ে কাঠ, আ---ম আর হচ্ছে না!
বুড়ি খনখনে গলায় বললে- “ওরে আবাগীর ব্যাটা, ঐ নামে আর কাজ হবে নে, খালপাড়ের বেম্মদত্যির কাচে ভুতেষ্টি কবচ পরে লিয়েচি। তাই যতোই রাম রাম বলিস, কিচ্ছুটি হবার লয়। এই দ্যাখ্ আমি ও বলচি রাম রাম রাম, কিছু হলো?“
লেটো বললে - “ও ঠাকমা, পায়ে পড়ি ছেড়ে দাও না, আর বছরে তোমাদের টুসী গাছের আম আমি পাড়িনি, শুভ পেড়েছিল, আমি তো শুধু তলায় দাঁড়িয়ে কুড়ুচ্ছিলুম”।
“ধম্মপুত্তুর যুধিষ্ঠির এয়েচেন আমার,
কুড়ুচ্ছিলুম!বলি গাচের কামরাঙা গুলো কে সাফাই করেছিল শুনি?” – বুড়ি জবাব দিলে ।
“ও ঠাকমা, আর কোনোদিন হবে নে গো, এইবারটি মাপ করে দাও” - ককিয়ে উঠলো লেটো ।
“খেঁদি আর খেঁদির বর এয়েচে দেখলুম তোদের ঘরে, লিশ্চয় মিষ্টি এনেছে, আর বাড়িতে জামাই এলে মাংস তো হবেই। যা একটা কাগজের পেলেটে করে মিষ্টি আর মাংস নিয়ে আয়, ছেড়ে দেবো” - বললে বুড়ি।
লেটো সাহস পেয়ে বললে – “কিন্তু ও ঠাকমা, তোমরা যে বোস্টম! তুমি মাংস খাবে?”
বুড়ি বললে – “ওইটাই তো কাল হলো রে! চির টা কাল মাছ মাংস না খেয়ে নোলা সামলে এলুম কিন্তু মনের বাসনা যায়নি, তাই ভূত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্চি। এখন ওসব খেলে তবে ফের জম্ম হবে”।
লেটো বললে - “তাই দেবো ঠাকমা” । মনে মনে ভাবছে একবার গাছ থেকে নামতে পারলে হয়। আর কেউ এদিকে আসে ?
বুড়ি বললে - “উঁ হুঁ ,আগে তেমাথার কালীর নামে পিতিজ্ঞে কর এখন থেকে যা যা বলবো দিয়ে যাবি, নইলে তোর ঠাম্মা কে কালকেই তুলে নেব”।
তেমাথার কালী খুব জাগ্রত, ওনার নাম করে প্রতিজ্ঞা করলে রাখতেই হবে।
তাই করলো লেটো, গাছটা পলকের মধ্যে যেমন ছিল তেমনি হয়ে গেল, নেমেই ব্যাগ নিয়ে চোঁ চাঁ দৌড়।
বাইরের কল থেকে ঘাড়ে মাথায় জল দিয়ে একটু ধাতস্থ হয়ে তবে ঢুকলো ঘরে। বাবা বললে- “এতো দেরি করলি যে ? নে নে পড়তে বোস”।
কিন্তু এখন চিন্তা হলো খাবার টা বুড়ি পেত্নি কে পৌঁছবে কি করে। ও সবে ক্লাস ফোর, সত্যি কথা বাড়িতে বললে কেউ বিশ্বাস করবে না।
পড়া হয়ে গেল, মা আর রাঙাপিসি রান্না সেরে দাওয়ায় বসে গল্প করছে, পিশেমশাই বাবার ঘরে । টুকুন টা এমন গল্পের পোকা, সেই সন্ধ্যে থেকে ঠাম্মার কাছে গল্প শুনে যাচ্ছে । লেটো ফন্দি এঁটে বললে – “মা, তুমি আর রাঙাপিসি একটু টিভি দেখবে তো দেখো না”। মা বললে - “না রে ,রান্না ঘরের জানলার একটা পাল্লা ভেঙে গেছে, বেড়াল ঢুকতে পারে, তাই পাহারা দিচ্ছি”। লেটো বুক ঠুকে বললে – “আমি তো আছি,তোমরা যাও”।
রাঙাপিসি হেসে বললে - ”তবে তুই বোস পাকা ছেলে। চলো বৌদি, আধঘন্টা পরে সবাই কে একসঙ্গে খেতে দিয়ে দেব”।
সুযোগ পেয়ে পুরোনো কাগজের প্লেটে করে
গোটা দুয়েক রসগোল্লা আর চার পিস মাংস সরিয়ে এক ছুটে শ্যাওড়া গাছের নীচে রেখে এলো লেটো। মিনিট চারেক লাগলো ছুটে যেতে আর আসতে। তবে বুড়ি পেত্নি কে আর দেখেনি। হয়তো, হাওয়ায় মিশে থেকে সবই দেখেছে। ঠাম্মা কে বাঁচানোর জন্যেই এই চুরি, এতে দোষ হবে না নিশ্চয়ই ।
ভোরবেলা লেটো তখনও ঘুম থেকে ওঠেনি, মাথা গোড়ার জানালা দিয়ে সেই খনখনে আওয়াজ টা আবার শোনা গেল - “লেটো রে, তোর মায়ের হাতের রান্না খুব ভালো। আজ তোদের ঘরে মাছ হবে। তোর বাবা সদরপুকুরে মাছ ধরাবে আমি শুনেছি, দু পিস মাছ আমাকে দিয়ে যাস দুপুরে”। ও ঘুরে তাকাতেই সট করে কে যেন সরে চলে গেল ।
কি আর করা! হুকুম পালন করতে হলো। এরপর প্রায় ই এবেলা ওবেলা ফরমায়েশ তামিল করতে করতে বিরক্ত হয়ে গেল লেটো। বিশেষ করে যেদিন যেদিন আমিষ রান্না হয়
সেদিন ই পেত্নি বুড়ির আবদার আসে। চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লেই শেষ! নিজেদের ঘরে কাঁহা তক আর খাবার চুরি করতে ভালো লাগে! একদিন তো মা বলছিল, বেড়াল টা বোধহয় কোন ফাঁকে ঢুকে মাছ সরাচ্ছে, নইলে মাছের পিস রোজ কম হচ্ছে কেন ?
মুশকিল হলো সেদিন ডিমের ঝোল চেয়ে বসায়, ডিম তো গোনা গুনতি, চুরি করলে একজনের কম পড়বে। শেষে একটা পলিথিন প্যাকেট পকেটে নিয়ে খেতে বসলো লেটো, নিজে না খেয়ে পলিপ্যাকে ঢুকিয়ে রেখে পরে বুড়ি কে দিয়ে এলো।
শেষটায় আর পেরে না উঠে, একদিন সন্ধ্যেবেলা ঠাম্মা যখন টুকুন কে ভূতের গল্প শোনাচ্ছে তখন গিয়ে সব বলে ফেললো সে। টুকুন বললে সে কিরে লেটো, তোর তো খুব সাহস! ঠাম্মা খানিক গম্ভীর হয়ে রইলো, তারপর বললে – “এখন যেমন করছিস করে যা, যা ব্যবস্থা করার আমি করচি। তবে আর
কাউকে কিচ্ছু টি বলবিনি”।
পরের দিন সকালে পচার বাবা অনন্ত কাকা কে আড়ালে ডেকে সব খুলে বললে ঠাম্মা । অনন্ত কাকার তো মাথায় হাত! বলে – ছি ছি, মায়ের শেষকালে এমন দুর্মতি হলো, বোস্টমের ঘরের ভূত পেত্নি হয়ে কিনা মাছ মাংসের দিকে লোভ। এতো পন্ডিত মশাই কে ডেকে পেরাচ্চিত্তির করতে হবে গো জেঠি। ঠাম্মা ধমকে বললে – এখানে আর কিছুই নয়, তুই সোজা গয়া চলে যা, সেখানেই পেরাচ্চিত্তির করিয়ে একেবারে পিন্ডি দিয়ে আসিস ।
দিন তিনেক পরেই অনন্ত কাকা গয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল, সঙ্গে পচার কাকা বসন্ত। গয়া থেকে কাজ সেরে ফিরতে সপ্তাহ খানেক লাগবে। এদিকে, ক্ষেন্তি বুড়ির আবদার যথারীতি চলছে । একদিন দুপুরে মাছের মাথা দেওয়া পুঁইশাকের তরকারি পৌঁছতে গেছে, বুড়ি শ্যাওড়া গাছের ডালে বসে ঠ্যাং দুলিয়ে বললে - “লেটো রে, শুনেচি তেঁতুল দিয়ে পুঁটি মাছের
টক খুব ভালো হয়। কোনো দিন তো খাইনি, কাল একটু দিয়ে যাস না। অবস্থা সামাল দিতে ঠাম্মা লেটোর মায়ের কাছে পুঁটি মাছের টক খাবার বায়না ধরলে, রান্না ঘর থেকে সরানোর দায়িত্বও ঠাম্মা ই নিচ্ছে ক’দিন ধরে। একদিন ঠাম্মা যখন উঠোনের রোদে বড়ি শুকোতে দিচ্ছিল, ঠাম্মার মাথার পাশ দিয়ে একটা বড় মাটির ঢেলা উড়ে চলে গেল হঠাৎ। লেটো তখন ইস্কুলে, ফিরে এসে শুনে বললে - “এবার তাহলে কি হবে ঠাম্মা ? ঠাম্মা বললে ভাবিসনি, অনন্ত যে গয়া গেচে, সেটা টের পেয়েচে ক্ষেন্তি । তাই আমার ওপর আক্রোশ । নেহাত গুরুদেবের দেওয়া কবচ টা ছিল বলে বেঁচে আচি। আজ কালের মধ্যেই হয়তো পিন্ডি দেওয়া হয়ে যাবে, তারপর সব শান্তি ।
পরের দিন ভোরে যখন লেটো বিছানায় ঘুমিয়ে কাদা, জানলা দিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার একটা আওয়াজ পেল সে, তারপরেই সেই খনখনে গলায় ক্ষেন্তি বুড়ি বললে - “ না হয় মাঝেমধ্যে একটু আধটু ভালো মন্দ খেতেই চেয়েছিলুম
তোদের কাচে, তাই বলে এমনি করে শত্তুরের কাজ করলি! আমি তো চললুম, তোর ঠাম্মা কে বলিস, ওকে ও একদিন আমার মতোই কাঁদতে হবে”। একটা দমকা হাওয়া জানলার পাল্লা গুলো কে দুলিয়ে দিয়ে হু হু শব্দে অনেক দূরে চলে গেল মনে হচ্ছে। চোখ রগড়ে উঠে বসলো লেটো।
সকালে অনন্ত কাকা এসে ঠাম্মা কে জানিয়ে গেল যে গতকাল রাতেই ফিরেছে মাকে পিন্ডি দিয়ে ।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচল লেটো, কিন্তু বুড়ির শেষ কথাগুলো মনে করে এখন খুব কষ্ট ও হচ্ছে , কাজ টা কি ও ভালো করলো ?