উত্তরণ 

   মিঠুন মুখার্জী 

 

ছোটনাগপুরের এক পাহাড়ি গ্ৰামে গালকাটা কালিয়া নামে বছর কুড়ির একজন ডন ছিল। তার ভয়ে সেখানকার সাধারণ মানুষেরা কাঁপত। একবার মারামারি করতে গিয়ে ছুঁড়ির আঘাতে তার গাল কেটে গিয়েছিল। সেই থেকে সকলে তাকে গাল কাটা কালিয়া বলে ডাকত। নিজেকে সে গব্বর সিং বলে মনে করত। কথায় কথায় বলত 'জো ডর গায়া সামঝো ও মর গায়া।' তার ভয়ে সকলেই তাকে গব্বর সিং বলেই ডাকত। কিন্তু সেখান থেকে তিন কিলোমিটার দূরে ছিল তার আসল গ্ৰাম। মানে যেখানে তার পরিবার থাকত। সেখানকার

 

মানুষেরা কেউ কেউ তার গব্বর নাম শুনে খুবই হাসত। তারা বলত ---- " ও নামেই গব্বর, স্বভাবে জব্বর ভিতু। পাড়ার রুগ্ন বিড়ালটাও ওর সামনে নিজেকে চিতাবাঘ ভাবে।"

 

   একটি অবাক করা বিষয়, কালিয়া নিজের গ্ৰাম মায়াপুরে আসলে সত্যি সত্যিই পাল্টে যেত। ওর সমস্ত শক্তি ও মেজাজ একেবারে জল হয়ে যেত। গ্ৰামের মানুষেরা তাকে নিয়ে সর্বদা ঠাট্টা তামাশা করত। চরিত্রের এই বিশাল পরিবর্তন কেন হত তা সে নিজেও জানত না। এক দেহে দুরকম সত্তা। ভিতরের আমি আর বাইরের আমি। বাইরে যতই সাহস নিয়ে লোকেদের ভয় দেখিয়ে পয়সা উপার্জন করুক না কেন, ভিতরের আমির সত্য তার নিজের গ্ৰামের মানুষের সামনে প্রকাশ পেতই। তাই সেখানে ছলনার আশ্রয় নিতে পারত না সে।

 

একদিন তার শোয়ার ঘরে একটা আরশোলা তার গায়ের উপর এসে বসেছিল। তখন সে এমন চিৎকার করেছিল যে, সমগ্ৰ পাড়ার মানুষ

 

তাদের সদর দরজার সামনে এসে ভিড় জমিয়েছিল। চিৎকার শুনে সকলের মনে হয়েছিল কালিয়াদের বাড়িতে বাঘ পড়েছে। হরি সেন নামক একজন প্রতিবেশী কালিয়ার বাবাকে বলেছিলেন --- " আপনার ছেলে পারেও বটে। আরশোলায় ভয় পায়। ও তো মেয়েদের চেয়েও অধম।" তার কথা শুনে ভিড় জমানো মানুষেরা সকলে হো হো করে হেসে উঠেছিল এবং কালিয়া সম্পর্কে নানান মন্তব্য করেছিল। তারা চলে গেলে কালিয়ার বাবা কালিয়াকে খুবই বকেছিলেন। কালিয়া বুঝে উঠতে পারত না এটা কেন হয়। সকলে তাকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করুক তা সে চায় না। কিন্তু মনের ভিতরে বাসা বেঁধে থাকা ভয়ও কোনো মতে সে দূর করতে পারে না। নিজের গ্ৰামের কারো সঙ্গে ঝামেলা করা ও ন্যায্য কথা বলার সাহসটুকুও সে পায় না। 

 

একদিন বাজারের একটি দোকানে কালিয়ার মা মুদিখানার জিনিস আনতে পাঠিয়েছিলেন। সে জিনিসপত্র নেওয়ার পর দোকানদারের হাতে

 

টাকা দিলে তিনি একশো টাকা বেশি কেটে টাকা ফেরৎ দেন। তাকে বোকা পেয়ে ঠকায় সে। কালিয়া বাড়িতে আসার সময় হিসেব করে দেখে একশো টাকা দোকানদার বেশি নিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে সেই দোকানে ফিরে গিয়ে কালিয়া দোকানদারকে বলে --- " কাকু আপনি আমাকে একশো টাকা কম দিয়েছেন। আমায় একশো টাকা ফেরত দিন।" কিন্তু সেই দোকানদার কোনোভাবেই স্বীকার যায় নি যে সে একশো টাকা কম দিয়েছেন। বরং কালিয়াকে ধমক দেন তিনি। ভয়ে কালিয়ার দুটো পা কাঁপতে থাকে। কি করবে তা বুঝতে পারে না। ভয়তে খুব জোরে দৌড়ে বাড়ি চলে আসে। মা জানতে পারলে তাকে মারবে তাই সে কারোকে কিছু না বলে আলমারির ভিতরে আধাঘন্টা লুকিয়ে ছিল। আধা ঘন্টা পর তার বাবা তাকে আলমারি থেকে উদ্ধার করেন। সে ঘেমে স্নান করে যায়। ভয়তে জামা-কাপড়ের মধ্যে হিসু করে দেয়। তারপর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হলে তার বাবা - মাকে সে সব বলে। মা বলেন --- " যাক একশো টাকা। তুই সুস্থ

 

থাকলেই হবে।" মার কথা শুনে কালিয়া খুশি হয়।

 

কালিয়া একদিন শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগল, তার মধ্যে যে করেই হোক সাহসের সঞ্চার ঘটাতে হবেই, নতুবা তার গ্ৰামের মানুষদের কাছ থেকে ও লোক মুখে মুখে তার প্রকৃত পরিচয় সকল মানুষ জেনে গেলে তাকে কেউ ভয় পাবে না। ফলে তার এতো দিনের ধান্দা বন্ধ হয়ে যাবে। ছোটনাগপুরের পাহাড়ি গ্ৰামের মানুষরাও আর ভয় পাবে না। সেই দিন থেকেই নিজের জীবনযাপন পাল্টে ফেলে সে। কারো সঙ্গে বেশি কথা বলে না, নিজের ওয়েট নিয়ে চলে, মনের মধ্যে অসীম সাহসের উদয় ঘটায় এবং অন্যায়কারীকে নিজেই শাস্তি দেয়। তার এই হঠাৎ করে পরিবর্তন দেখে গ্ৰামের মানুষ ও বাড়ির লোকজন অবাক হয়ে যায়। তাকে নিয়ে কেউ ঠাট্টা করলে তার গালে টেনে একটা থাপ্পর বসাত এবং বলত ---- 'জো ডর গায়া সামঝো ও মর গায়া।' ধীরে ধীরে কালিয়া তার দলবল নিয়ে নিজের গ্ৰামেও উৎপাত চালায়। কালিয়ার

 

গ্ৰামের মানুষেরাও এরপর থেকে কালিয়াকে যমের মতো ভয় পেতে থাকে। সকলে বুঝতে পারে প্রতিটি মানুষের মধ্যে একটা সিংহ বাস করে। সকল ভয় কাটিয়ে সেই অন্তরের সিংহের জাগরণ ঘটাতে হবে। তবে তাকে সকলে মান্য করবে, ভয় পাবে। এ দুনিয়াটা ক্ষমতা ও সাহসের বশ।