গনগণিতে এক রাত
নিবেদিতা কবিরাজ
তোরা হাত ধর প্রতিজ্ঞা কর চিরদিন তোরা বন্ধু হয়ে থাকবি, নিজেদের অজান্তে এমন প্রতিশ্রুতি হয়তো দিয়েছিলো ওরা ছ' জনে। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে নরসিংহ দত্ত কলেজে ভর্তি হয়েছিলো আর পাঁচজন ছাত্রছাত্রীর মতোই, তারপর মনের মত মন পেতে সময় লাগেনি প্রজাপতিদের। কত দস্যিপনা নিয়ে কেটেছিলো স্বপ্নমাখা কলেজজীবন। তারপর দীর্ঘ ৩০ বছর, আজও অটুট সেই বন্ধন।
হ্যাঁ, আজও ওরা প্রজাপতির মতোই রঙিন, ফুরফুরে, ডানা মেলে ওড়ে। রঙবেরঙা
ঘটনাবহুল জীবন নিয়ে ওরা বেজায় মত্ত। এসেছে হাজারো মন খারাপের দিন, মুখোমুখি হ'তে হয়েছে জীবনযুদ্ধের গ্লানিমাখা অভিজ্ঞতার; তবুও হার মানেনি ওরা, আনন্দগুলোর স্বাদ চেটেপুটে নিয়ে কষ্টগুলো কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েছে বার বার।
দিন আসে দিন যায় কেটে যায় বছর, তাতে থাকে টিকে থাকার সংগ্রাম, তার থেকে যা কুড়িয়েছে, তা ওদের সমৃদ্ধ করেছে দিনে দিনে। ছেলেমানুষিকে বাঁচিয়ে রেখে আজও ওরা হাত ধরে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায় জীবনের ঝোলা পূর্ণ করতে।
এবারে প্রবাহীর বড়ো গাড়িতে করে সবাই মিলে গনগনি যাবে আবদার ছিলো প্রবাহীর কাছে, প্রবাহী ও রাজি। সবার যত আবদার, ব্যাগ দে, কুর্তি দে, এটা দে, ওটা দে লেগেই আছে আর প্রবাহীও যেন দিতে পারলে বড়োই খুশি, বলে তোরা না চাইলে কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে।
অনেক চেষ্টা করেও খুশি এবার যেতে পারলো না ওর স্কুলের স্পোর্টস থাকায়। তাছাড়া ওর মেয়েটাও টুয়েলভে উঠেছে, বাড়িতে একা রেখে বেরোতেও মন চায় না খুশির। স্কুলের চাকরি ছাড়াও নিজের নাচের স্কুল আছে, স্বামী সংসারের দায়দায়িত্ব সব কিছু নিয়ে খুশি বড়ই ব্যস্ত। বন্ধুদের এই ডাক, ছ' জনের এক হওয়া খোলা আকাশের নিচে এই স্বচ্ছ সবুজ নিশ্বাস বড়ো আরামের, তবুও এবার কিছুতেই সময় হয়ে উঠলো না খুশির।
সকাল সকাল নৈহাটী থেকে নিবেদিতা, গড়িয়া থেকে স্বাতী, সল্টলেক থেকে দেবযানী চলে এসেছে ঠিক সময়ে। নিবেদিতাকে অবশ্য বিধাননগর স্টেশন থেকে নিয়ে এসেছে দেবযানী আর ওর স্বামী কৃত্তিবাস ওদের গাড়িতে, তারপর কৃত্তিবাস কে বিদায় জানিয়ে
সবাই মিলে উঠে পড়ে প্রবাহীর গাড়িতে।
গাড়ির মালকিন পিছনে বসেই ডিম সেদ্ধর খোঁজ করে, "স্বাতী হাঁসের ডিম সেদ্ধ এনেছিস?" ডিমের ঝোলা দেবযানীর কোলে দিয়ে স্বাতী জবাব দেয়, "কাল রাতে সেদ্ধ করেছি, ডিম ফুটে যাবার আগে চটপট খেয়ে নে"। নিবেদিতার জিজ্ঞাসা , "আমার জন্য দুটো এনেছিস তো?" প্রবাহী একগাল হেসে, "আমারও দুটো চাই"। ডিমের লড়াই করতে করতে হাওড়া দ্বিতীয় হুগলী ব্রিজ এসে গেলো, ওখান থেকে সোমাকে তুলে গাড়ি ছুটলো বোম্বে রোড ধরে।
এই সোমাকে ওরা দীর্ঘদিন খোঁজাখুঁজির পর খুঁজে পেয়েছে, বিয়ের পর চলে গেছিলো আসাম, ওখানেই ওর শশুরবাড়ি, বন্ধুদের কারোর সাথেই যোগাযোগ করতে পারেনি আর, বেশ কাটছিল হেসেখেলে স্বামী সন্তান নিয়ে।
তারপর হঠাৎই নেমে এসেছিলো এক বিপর্যয়, স্বামীহারা সোমাকে অনেকটা লড়াই করতে হয়েছিলো দুটো মেয়েকে নিয়ে। জীবনযুদ্ধে লড়াই করতে করতে ক্লান্ত একাকিনি সোমাকে ফিরতে হয়েছিলো দুই মেয়েকে নিয়ে হাওড়ায় শিবপুরে ওর বাপেরবাড়িতে। আজ অবশ্য এক মেয়ে চাকরি করছে আরেক মেয়ে গ্রাজুয়েশন। হাজারো লড়াই নিয়ে আজও হাসতে ভোলেনি সোমা, ভুবনভোলানো হাসি দিয়ে মুগ্ধ করে বন্ধুদের।
সবাই খাবার যা এনেছে তাই দিয়ে গাড়িতেই সকালের জলখাবার সারা হয়ে গেলো ওদের। তারপরই শুরু হলো, কানাইদা চা খাবো। কানাইদা প্রবাহীর ড্রাইভার, ভদ্র, মার্জিত, বিশ্বস্ত যার সাথে নিশ্চিন্তে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড ঘোরা যায়। প্রবাহীর জন্য এমন মানুষ বোধহয় ভগবানই জুটিয়ে দেন। একা একা মেয়েকে নিয়ে থাকা, প্রবাহীর হাসব্যান্ডের জাহাজে চাকরির জন্য তিনি বছরে বারদুয়েক আসেন। শশুরবাড়ি,
বাপেরবাড়ির সব দায়িত্ব কর্তব্য ওকেই করতে হয়, একাকে সামলাতে হয় বলেই কানাইদার মতো বেশ ক'জন মানুষের ওপর ওকে নির্ভর করতে হয়, তারা প্রত্যেকেই যেন ভগবান প্রদত্ত।
চা এর নামে ফটো সুট, কোলাঘাটের আগেই একটা চায়ের দোকানে চা খাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে রথ দেখা কলাবেচা দুই ই হলো। গাড়ির মাথায় ওঠা গেলো না তাই, নাহলে ওটুকুও বাকি থাকতো না। ফটো তোলার জন্য এরা লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে কি না করলো, একটা সময়ে গাড়ির দরজাগুলো ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচিও বললো বোধহয়, ফটো তোলার জন্য এতটাই অত্যাচারিত দরজাদুটো। কে বলবে এদের কেউ পঞ্চাশ, কেউবা পঞ্চাশের দোরগোড়ায়, বন্ধুদের দেখলে আজও একই সেই ছেলেমানুষি।
এরপর গাড়ি ছুটলো পাঁশকুড়ার দিকে, গন্তব্য এখন ক্ষীরাই, পশ্চিমবঙ্গের ভ্যালি অফ
ফ্লাওয়ার। পৌঁছতে বেশি সময় লাগলো না, 30 মিনিটেই ফুলের রাজ্যে। আহা চোখ জুড়োনো দৃশ্য, চারিদিক ফুলে ফুলে ঢোলে ঢোলে, নীল আকাশের নিচে রঙের বাহার, কোথাও গোলাপ, কোথাও চন্দ্রমল্লিকা, কোথাও বা জিনিয়া, আরও কত রঙিন ফুলের চাষ মাঠের পর মাঠ। কিছুক্ষণ থেকে ওরা আবার গাড়ি ছোটালো গড়বেতার জঙ্গলে, গনগনির দিকে।
গড়বেতা সোনাঝুরি রিসোর্ট পৌঁছতে সময় লাগলো দু' ঘন্টা মতো, ওখানেই একটা ডরমেটরি বুকিং করে রেখেছিলো স্বাতী, 'গনগনিতে এক রাত্রি' প্ল্যানটা স্বাতী বেশ কয়েকমাস ধরে করেছে কিন্তু কিছুতেই ছ' জনের সময় মিলছিলো না, এদিকে শীতটাকেও হাতছাড়া করার ইচ্ছে নয়, হাজারো অসুবিধে নিয়েই চলে এসেছে প্রবাহী। মাত্র কদিন আগেই কাকা মারা গেছেন, আগামীকাল ওনার কাজ, অনেকটা দায়িত্ব ওর মাথায় তবুও বন্ধুদের আবদারকে প্রশ্রয় দিয়ে চলে এসেছে আজ।
ওরা চটপট লাঞ্চ সেরে নিলো রিসোর্টের ডাইনিংয়ে, তারপর ছুটলো গনগনির দিকে। লালমাটি রোদ্দুরে আগুন হয়ে থাকে, ভরা শীতেও সোয়েটার, চাদর খুলে ফেলতে হয়েছে ওদের। রিসোর্ট থেকে স্পটে পৌঁছতে কুড়ি মিনিট মত সময় লাগলো গাড়িতে।
পশ্চিম মেদিনীপুরে এই গনগনি Grand canyon of Bengal, এক ঝটকায় দেখলে শিলাবতী নদীর দাপটে কোনো ঐতিহাসিক ধংসাবশেষ মনে হয়, লাল মাটির স্তুপ সূর্যের আলোয় আগুনের ঝলকানি যেন, শাল সেগুনের জঙ্গলের মাঝে শিলাবতী বয়ে চলেছে, তারই মাঝে রক্তিম পাহাড়ের অবক্ষয়, প্রকৃতির অপূর্ব রূপে ওরা পাঁচ বন্ধু মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে বেশ কিছু সময়, এদিকে দেখতে দেখতে সময় অনেকটা পেরিয়ে গেছে। প্রবাহী এবার ঘড়ি দেখে বললো "এবার তোরা থাক আমি যাই, আমাকে আজ ফিরতেই হবে, কাল কাকার কাজ আমি বাড়ির বড়ো মেয়ে, আমায় আটকাস না আজ"। সবাই চুপ, এটুকু মেনে
নিতেই হবে, অগত্যা স্বাতী, নিবেদিতা, দেবযানী আর সোমার চোখের কোণে জল চিকচিক করলেও এগিয়ে গিয়ে প্রবাহীকে গাড়িতে তুলে কানাইদা কে বলে সাবধানে যেও। সবাই মনমরা হয়ে গেলো।
চারজনে ফিরে এলো সূর্যাস্ত দেখতে, গনগনি তে সূর্যাস্তটা একটা অদ্ভুত অনুভূতি এনে দিলো ওদের, সবাই নির্বাক হয়ে ঠায় চেয়ে আছে, পড়ন্ত বেলার সূর্য, নদী, জঙ্গল আর গনগনির ধংসস্তুপে পরে কেমন যেন মায়াবিনী হয়ে আছে, আছন্ন করেছে ওদেরকে। সন্ধে নেমেছে একটু আগেই, ওরা পায়ে পায়ে ওপর থেকে নেমে একটা চায়ের দোকানে চা খেয়ে টোটো ধরে ওরা সোনাঝুরি রিসোর্টে ফিরলো।
রিসোর্টের একজন চা, পাকোড়া দিয়ে গেলো আর বলে গেলো দিদি আপনাদের ক্যাম্প ফায়ার রেডি। ওরা শুনেই লাফিয়ে উঠলো, পরিবার ছাড়া ছয় বন্ধুর চার বন্ধু একসঙ্গে
একটা রাত কাটানোর আনন্দ যেন ওদেরকে কলেজজীবনে ফিরিয়ে নিয়ে গেলো।
স্বাতী চটপট ব্যাগ থেকে ক্যারাভ্যান বার করে জোরে গান চালিয়ে নেমে গেলো রিসোর্টের পিছনের মাঠে।
স্বাতীর সবেতেই এতো উৎসাহ, এতো বেঁধে রাখার ক্ষমতা যা সবার মধ্যে থাকে না। শুধু বন্ধুদেরই নয়, পরিবার, প্রতিবেশী সকলকে আগলে রাখে নিজমহিমায়।
রিসোর্টের পিছনে জঙ্গলে ঘেরা ছোট্ট মাঠ, ঘুটঘুটে নিকষ কালো অন্ধকার তার মাঝে ক্যাম্প ফায়ার, ক্যারাভ্যানে চলছে লাল পাহাড়ের দেশে যা।
অন্ধকার মাখা চারজনে আপন খেয়ালে নেচে উঠেছে, দেখে মনে হয়ে ওরা আজও নরসিংহ দত্ত কলেজেই পড়ে, কে বলবে ওদের মেয়েরা
কেউ কলেজে পড়ে কেউবা চাকরি করে, কমলা নেত্য করে থমকিয়া থমকিয়া গানে ওরা ভেসে গেছে এক অনাবিল আনন্দে।
বেশ বেশ ভোর ভোর উঠে চান করে রেডি হয়ে চারজনা একটা টোটো নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে গড়বেতা জঙ্গলমহল, লালমাটির রাস্তা, দুদিকে ঘন জঙ্গল ধরে চললো টোটো সাথে দেবযানীর গান হারে রে রে রে রে আমায় ছেড়ে দে রে দে রে, মধুমাখা গলা দেবযানীর, সবাই কে স্তব্ধ করে দিয়েছে এক নিমেষে, একের পর এক গান আর মায়াবী জংলী রাস্তা ঘন্টাখানেক কেন গোটা দিন কাটানো যায়।
টোটো দাঁড়ালো জঙ্গলে ঘেরা এক জলাশয়ের সামনে যেখানে হাতি রোজ জল খেতে আসে। কি অপূর্ব জায়গা, ভরা শীত,লাল মাটি, শাল পিয়ালের জঙ্গল সকালের সূর্য প্রকৃতি যেন মনোহরা। জঙ্গলের পথ ধরে চার বন্ধু গল্প করতে করতে খিলখিলিয়ে হেসে উঠছে
মাঝেমধ্যে, প্রাণবন্ত হাসিগুলো গাছের কলকাকলির সুর মিলিয়ে মনে হয়, সময় যেন থমকে গেছে।
আজই ফেরার দিন, ওরা চারজনা রিসোর্টে এসে ব্যাগ গুছিয়ে টোটোয় চেপে চললো গড়বেতা স্টেশন, ট্রেনে গড়বেতা থেকে মেদিনীপুর, আবার মেদিনীপুর থেকে হাওড়া। মেদিনীপুর থেকে হাওড়া বেশ অনেক্ষন, ফাঁকা ট্রেনে হাতপা ছড়িয়ে বসলো চারজন।
ওদের হাসি, গান, গল্প, ঠাট্টার সঙ্গী হয়ে গেলো ট্রেনের আরও ক'জন, হাসতে হাসতে দুটি ঘন্টা কিভাবে চলে গেছে। এবার ফিরতে হবে যে যার বাড়ি, ফিরতে হবে কাজে, ফিরতে হবে যে জোয়ারে।।