রানা জামান
রানা জামান
উচ্ছন্নে
মেয়েটা নবম শ্রেণিতে উঠার সাথে সাথে রাতের ঘুম কমে গেলো রাজেকুস সামাদের। কোনো পরিবারে মেয়ে সোমত্ত হলে মা-বাবার দুশ্চিন্তা বাড়ে বই কমে না। সচেতন মা-বাবা মাঝে মধ্যে আড়ি পেতে মেয়ের কথাবার্তাও শুনে থাকেন। রাজেকুস সামাদ ও পাপিয়া সামাদ এর ব্যতিক্রম হতে পারেন নি।
সামাদ পরিবারের দুটো সন্তান। সোলায়মান আলম বড় এবং মৌমিতা ছোট। কোনো পরিবারে মা-বাবা ছেলেকে নিয়ে তেমন দুশ্চিন্তা করেন না, উচ্ছন্নে গেলেও। কলেজ পড়ুয়া সোলায়মানকে নিয়ে পাপিয়া সামাদ দুশ্চিন্তা না করলেও রাজেকুস সামাদকে করতে হচ্ছে। ছাত্র রাজনীতি পঙ্গপালের মতো ঝেঁকে বসেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয়। ছেলেটা কি রাজনীতিতে জড়িয়ে গেছে? না জড়িয়ে কি থাকতে পারবে? এ বিষয়ে ছেলেটার সাথে কথা বলা দরকার। আজই!
সারাদিন কেটে গেলো এটা ভেবে রাজেকুস সামাদের কিভাবে সোলায়মানের সাথে আলাপটা শুরু করবেন। দিনের আলো থাকতে ছেলেটা আসেনি বাসায়। কয়েকবার ফোন করেও সাড়া পাননি। এতে স্বাভাবিকভাবে দুশ্চিন্তা আরো বেড়ে যায়। ছেলেমেয়ে দুটো পাল্লা দিয়ে দেরি করে বাসায় ফিরছে। মেয়েটার সাথেও কথা বলতে হবে। আজ সম্ভব না হলে আগামীকাল অবশ্যই!
স্বামীর অস্থিরতা দেখে সন্ধ্যার পরে দুটো কফির কাপ নিয়ে পাপিয়া সামাদ ঢুকলেন অবসর কক্ষে। অবসর সময় কাটাতে রাজেকুস সামাদ এই কক্ষটা গড়ে তুলেছেন। অফিস থেকে বাসায় এসে রাজেকুস সামাদ এই কক্ষেই সময় কাটান। রাজেকুস সামাদ ব্যবসা করেন। ব্যবসা ভালোই চলছে ওঁর। মালয়েশিয়া থেকে টাইলস আমদানি করেন। বাংলামোটরে শো-রুম আছে। চলাচলের জন্য একটা জিপের মতো গাড়ি আছে।
ছেলেমেয়ে দুটো গাড়ি নিয়ে এখনো টানাটানি করে না। উনি ভেবে রেখেছেন খুব তাড়াতাড়ি একটা কার কিনবেন স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়ের জন্য। যদিও কথাটা এখনো বাড়ির কাউকে বলা হয় নি।
পাপিয়া সামাদ নিজ কফির কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, তোমাকে কেমন যেনো দুশ্চিন্তাগ্রস্থ দেখাচ্ছে। কী নিয়ে ভাবছো তুমি? ব্যবসায় কোনো সমস্যা?
রাজেকুস সামাদ কফির কাপটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে বললেন, সমস্যা একটা অনুভব করছি। তবে সেটা ব্যবসা নিয়ে না। ছেলেমেয়ে নিয়ে।
কী করেছে আমার ছেলেমেয়েরা?
সামনের দেয়াল ঘড়িটা দেখে রাজেকুস সামাদ বললেন, রাত আটটা বাজতে চলেছে। দুই ছেলেমেয়ের একটাও বাসায় ফেরেনি। এতো রাত পর্যন্ত বাইরে কী করে ওরা?
পাপিয়া সামাদ বললেন, আজ বাসায় আসলে দুই জনকেই আমি শাঁসিয়ে দেবো। তুমি কোনো টেনশন করো না।
তোমাকে কিছু বলতে হবে না। আমিই কথা বলবো। আজকেই। প্রথমে সোলায়মানের সাথে। পরে মৌমিতা।
তখন কলিংবেল বাজলে পাপিয়া সামাদ বললেন, সোলায়মান আসছে! আমি দরজা খুলে ওকে নিয়ে আসছি এখানে।
ঠিক আছে।
পাপিয়া সামাদ বেরিয়ে গেলেন অবসর কক্ষ থেকে এবং একটু পরে সোলায়মানকে নিয়ে ফের ঢুকলেন।
রাজেকুস সামাদ ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, বসো। তোমার সাথে আমাদের কিছু কথা আছে।
অবসর কক্ষে কোনো চেয়ার-টেবিল নেই। একটি ডিভান আছে এবং এক সেট সোফা। ডিভানে আধশোয়া হয়ে আছেন রাজেকুস সামাদ। পাশাপাশি সোফায় বসলো মা ও ছেলে।
রাজেকুস সামাদ জিজ্ঞেস করলেন ছেলেকে, দৈনিক এতো রাত করে বাড়ি ফেরো কেনো সোলায়মান? কী করো এতো রাত পর্যন্ত বাইরে থেকে?
সোলায়মান বাবাকে একবার দেখে বললো, বাইরে অনেক কাজ থাকে বাবা।
তখন পাপিয়া সামাদ ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, বাইরে কী কাজ থাকে তোর? তোকে বাসায় পড়তেও দেখি না।
সোলায়মান মার দিকে তাকিয়ে বললো, ওসব তুমি বুঝবে না মা!
বুঝবো না কেনো? বুঝিয়ে বললেই বুঝবো!
সোলায়মান বললো, এখন কলেজ ভার্সিটিতে পাওয়ার পার্টির পলিটিক্স না করলে ক্লাশ করতে দেয় না। ওদের মিছিলে যেতে হয়, মিটিংয়ে যেতে হয়। অস্বীকার করলে মারপিট করে, ক্যাম্পাসে ঢুকতে দেয় না।
কী বলবেন এখন রাজেকুস সামাদ ভেবে পাচ্ছেন না। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরে গদি টিকিয়ে রাখার জন্য ছাত্র সংগঠনের লাগাম ছেড়ে দিয়েছে। পাপিয়া সামাদ তাকিয়ে আছেন স্বামীর দিকে। রাজেকুস সামাদ ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, মিছিল মিটিঙে সীমিত রাখো নিজেকে। চাঁদাবাজি মারপিটে জড়িয়ো না।
সোলায়মান বললো, আমি কমিটিতে ঢোকার চেষ্টা করছি বাবা। কমিটিতে ঢুকলে সাধারণ ছাত্রের মতন মিছিল মিটিঙে যেতে হবে না।
ওকে। তুমি এখন যেতে পারো।
সোলায়মান বেরিয়ে গেলে পাপিয়া সামাদ বললেন, কিছুই তো বললে না ছেলেকে!
আমি ভাবছি অন্য কথা।
কী?
ছেলেটা দেশে থাকলে সরকারের গুণ্ডায় পরিণত হবে। ওকে বাইরে পাঠিয়ে দেই।
এই বয়সেই?
সরকার ছাত্র সংগঠনকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করে ছাত্র সংগঠনের নেতাদের লোভী বানিয়ে ফেলছে।
ছাত্রাবস্থায়ই ওরা চাঁদাবাজি করে কোটি কোটি টাকা কামাই করছে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের দিকে আজ। ওদিকে সরকারের কারো নজর নেই। কারণ, ওদের ছেলেমেয়েরা এদেশে পড়ছে না।
কোথায় পাঠাবে?
কানাডায়। ওখানে তোমার ছোটবোন নাসরিন আছে না? তুমি ওর সাথে কথা বলো। আজই!
ওকে।
রাজেকুস সামাদ দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, শুয়ে পড়বো।
মেয়ের সাথে কথা বলবে না?
আজ আর ইচ্ছে করছে না।
তুমি যাও। আমি নাসরিনের সাথে কথা বলে আসছি।
মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে রাজেকুস সামাদের। ছেলেটাকে আচ্ছা করে ডাঁটবেন; কিন্তু হলো উল্টো। কী হচ্ছে দেশটাতে? গদি রক্ষার জন্য সবকিছু ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। মেয়েটার বেলায় কি ভিন্ন কিছু হবে? শয্যাকক্ষে এসে শুয়ে চোখ বুজে থাকলেন। ঘণ্টা খানেক পরে পাপিয়া এসে স্বামীকে চোখ বুজে থাকতে দেখে কিছু না বলে ডিম লাইট জ্বালিয়ে শুয়ে পড়লেন পাশে।
প্রস্রাবের চাপে ঘুম ভেঙে গেলো রাজেকুস সামাদের। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালেন: মাত্র সাড়ে বারোটা বাজে। প্রস্রাব সেরে সংলগ্ন ওয়াশরুম থেকে বের হলেন। চোখে ঘুম নেই। ধূমপান করতে ইচ্ছে করছে। এক সময়ের চেইন স্মোকার কবে শেষ সিগারেট টেনেছেন, মনে করতে পারছেন না। টেবিলের ড্রয়ারে একটা সিগারেটের প্যাকেট আছে লাইটারসহ। বারান্দায় এসে সিগারেট জ্বালিয়ে টানছেন রাজেকুস সামাদ। মৌমিতার কক্ষ থেকে কথাবার্তার শব্দ শুনে ভ্রু কুঁচকে মনে মনে বললেন, এতো রাতে মেয়েটা কার সাথে কথা বলছে?
সিগারেটে দ্রুত কয়েকটা টান দিয়ে বারান্দার রেলিঙে চেপে আগুন নিভিয়ে সিগারেটটা ফেলে দিলেন বাইরে। পা টিপে মেয়ের কক্ষের দরজায় কান পেতে শুনে থমকে গেলেন রাজেকুস সামাদ।
শূন্য পাওয়ারের সবুজ আলোয় মৌমিতা পায়চারি করে মোবাইল ফোনে কথা বলছে। ওর চোখেমুখে খুশির ছটা বিচ্ছুরিত হচ্ছে। মৌমিতা কথা বলছে শায়লা নামে এক বান্ধবীর সাথে।
শায়লা বললো, শমশের যা বললো তা কি সত্যি?
মৌমিতা ভ্রু নাচিয়ে বললো, কী বলেছে শমশের?
তুই নাকি প্রেগনেণ্ট? ক্যামনে?
তুই কি হোস?
নাহ! প্রটেকশান ছাড়া আমি কাউকে কাছে ভিড়তে দেই না!
আমিও!
তাহলে প্রেগনেন্সির ব্যাপারটা?
ভালশুনটাক বেকুব বানানোর জন্য!
শমশের তোকে বিয়ে করতে চায়।
রিয়েলি?
হাঁ।
কিন্তু আমার এখনো বিয়ের বয়স হয়নি! এখন আমার মউজ করার বয়স!
তাহলে তুই প্রেগনেণ্ট হয়েছিস তা জনে জনে বলে বেড়াচ্ছিস কেনো?
সাব্বিরও তোর সাথে শেয়ার করেছে ব্যাপারটা?
হাঁ। কিন্তু সাব্বির তোকে বিয়ে করতে চায় না!
ঐ ভালশুনটা কী বলেছে?
ও বলেছে: তুই তো শুধু ওর সাথে মিশিস না, কার না কার কে জানে!
ঐ শালাকে আর আমার কাছে ভিড়তে দেবো না!
তোর উদ্দেশ্য কী মৌ?
ছেলেদের নাচানো!
মেয়ের কথাবার্তা শুনে রাজেকুস সামাদ দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। মাথায় হাত দিয়ে সেখানে বসে পড়লেন। খানিকটা ধাতস্থ হয়ে চলে এলেন শয্যাকক্ষে। কী করবেন তিনি এখন? স্ত্রীকে ডেকে বলবেন মেয়ের কীর্তির কথা, নাকি সকালে বলবেন। তাকালেন স্ত্রীর দিকে। ঘুমাচ্ছেন পাপিয়া। মৃদু নাক ডাকছেন। কিন্তু পাপিয়া কখনোই তা স্বীকার করেন না। মন খারাপের মাঝেও মুচকি হেসে শুয়ে পড়লেন স্ত্রীর পাশে। কিন্তু ঘুম এলো না। কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে উঠে বসলেন বিছানায়। তাকিয়ে রইলেন স্ত্রীর দিকে। গায়ে হাত দিয়ে ধাক্কা দিলেন। ঘুম ভাঙলো না পাপিয়া সামাদের। এবার গায়ে জোরে ধাক্কা দিয়ে ডাক দিলেন রাজেকুস সামাদ, এই উঠো!
এভাবে ডাকলে কুম্ভকর্ণ না হলে ঘুম ভাঙতে বাধ্য যে কারো!
পাপিয়া সামাদ জেগে বিরক্তি নিয়ে স্বামীর দিকে তাকালেও মেয়ের বিষয়ে জেনে থ হয়ে গেলেন। কিন্তু বিশ্বাস করতে না পেরে বললেন, আমার মৌ অমন হতে পারে না। তুমি ঠিক শুনেছো তো?
রাজেকুস সামাদ রুক্ষ কণ্ঠে বললেন, আমার কথা বিশ্বাস না হলে তোমার মেয়েকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো! ও এখনো জেগে আছে!
পাপিয়া সামাদ ম্যাক্সি পরে ঘুমান। বিছানা থেকে নেমে পাশের আলনা থেকে ওড়নাটা নিয়ে গায়ে ঝুলিয়ে বেরিয়ে গেলেন কক্ষ থেকে। রাজেকুস সামাদ স্ত্রীর পেছনে দরজা পর্যন্ত এসে ফিরে গেলেন বিছানায়। পাপিয়া সামাদ পেছনে না তাকিয়ে এগিয়ে গেলেন সামনে। দরজায় টোকা দেবার সাথে সাথে বললেন, দরজা খোল্ মৌ!
মৌমিতা দরজা খুলে দরজা থেকে না সরে বললো, তুমি এখনো ঘুমাও নি মা?
পাপিয়া শুকনো কণ্ঠে বললেন, ঘুমিয়েছিলাম!
তাহলে জাগলে কেনো?
তোর বাবা জাগিয়েছে আমাকে।
বাবার নিশ্চয়ই ঘুম পায় নি। বাবার মাঝে মধ্যে ইনসোমোনিয়া হয়।
আজ ইনসোমোনিয়া হয় নি, মোবাইল ফোনে তোর কথাবার্তা শোনে আমাকে জাগিয়েছে।
মৌমিতা কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলো।
পাপিয়া সামাদ বললেন, তুই তোর বান্ধবীদের সাথে যা বলেছিস, সব কি সত্য? নাকি ফাজলামো?
আমি বান্ধবীদের সাথে কত কথাই তো বলি। কোন কথার কথা বলছো মা?
তোর প্রেগনেন্সি বিষয়ে। কথাটা কি সত্য?
একদম সত্য না মা! বিশ্বাস না হলে প্রেগনেন্সি টেস্ট করো আমার!