গ্লানি যেথা মুক্তি
মহ: রিজওয়ান পারভেজ
বীরভূম জেলার একটি অখ্যাত গ্রাম উজানপুর।গ্রামের প্রান্ত ঘেঁষে ব্রাহ্মণী নদী মৃদুমন্দ গতিতে প্রবাহমান।বর্ষার জলে পুষ্ট নদী হওয়ায় বর্ষাকালে একমাত্র জল আসে।কোনো কোনো বছর বন্যা আশেপাশের গ্রামগুলির দুর্ভাগ্যের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।গ্রামের পশ্চিমদিকে মহাজন ঘোষাল মশাইয়ের আমবাগানের একপ্রান্তে প্রান্তিক চাষী শিবেনের একচালা ঘর।স্ত্রী অন্নপূর্ণা,কন্যা লক্ষ্মী এবং পুত্র রামু কে নিয়ে শিবেনের সংসার।রামু পাশের গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র।অভাবের সংসারে কন্যা লক্ষ্মীর আর হাতে খড়ি হয়নি।শিবেন,মহাজন ঘোষাল মশাইয়ের জমিতে ভাগে চাষ করে।তার স্ত্রী অন্নপূর্ণা ঘোষাল মশাইয়ের স্ত্রীর ফাইফরমাশ খাটে।এই প্রকার সুখে,দুঃখে শিবেনের দিনগুলি কেটে যাচ্ছিল।ঘোষাল মশাইয়ের পূর্বপুরুষ এককালে এই অঞ্চলের বর্ধিষ্ণু জমিদার ছিলেন।সময়ের পালাবদলে জমিদারি এখন আর নেই।কিন্তু যা এখনও আছে তাও আশেপাশের পাঁচ গ্রামের কারোর নেই।পূর্বপুরুষেরা মানব দরদী হলেও বর্তমান উত্তরাধিকারী নৃপেণ ঘোষাল নিজের স্বার্থ সম্পর্কে অধিক সচেতন।টাকা ধার দিয়ে চড়া সুদ আদায় করার বিষয়ে তার সুখ্যাতি বা কুখ্যাতি সর্বজনবিদিত।“সুখ্যাতি” এবং “কুখ্যাতি” দুটি শব্দই এক্ষেত্রে ব্যবহার করার কারণ,এই বিষয়টি ব্যক্তিবিশেষের উপর নির্ভরশীল।ঘোষাল মশাইয়ের সহিত গোপন আঁতাতে যাদের স্বার্থ চরিতার্থ হয় তারা ঘোষাল মশাইয়ের ক্ষেত্র বিশেষে সুখ্যাতি করে থাকেন।যদিও নৃপেণ ঘোষালের কৃপায় দারিদ্রতা গ্রামের অনেক মানুষের চিরসঙ্গী।প্রয়োজনে টাকা ধার নিয়ে সময় মতন ফেরত না দেওয়ায় তাদের বাস্তু বাটি,চাষের জমি অনেক কিছুই এখন নৃপেণ ঘোষালের ব্যক্তিগত খতিয়ানের অধীন।গ্রামের আর পাঁচটি প্রান্তিক চাষীর মতনই শিবেনের দুর্দশার সূচনা নৃপেণ ঘোষালের দৌলতেই।গতবছর অন্নপূর্ণা দেবী ম্যালেরিয়ার জ্বরে বেশ কিছুদিন ভুগেছিলেন।ডাক্তার দেখাবার জন্য শিবেন বেশ কিছু টাকা ধার নিয়েছিল ঘোষাল মশাইয়ের কাছে।টাকা ধার দেওয়ার সময় ঘোষাল মশাই শর্তাবলী উল্লিখিত কাগজে শিবেনের টিপ সই নিয়ে নেন।শিবেনের অক্ষর জ্ঞান নেই।ঘোষাল মশাই জোর গলায় জানিয়ে দেন,“কাগজে লেখা আছে সামনে ভাদ্র মাসের মধ্যে যদি সুদ সমেত টাকা ফেরত না দিতে পারিস তাহলে তোর দু–বিঘা জমি আর এক কাঠা জায়গার উপর ওই বসত বাড়ি আমি দখল করব”।শহরে গিয়ে অন্নপূর্ণা দেবীর ডাক্তার দেখানোর টাকা,পথ্য সব মিলিয়ে ঠিক সময়ে টাকা শোধ দিতে পারেনি শিবেন।তাই যা হওয়ার তাই হল।এক বস্ত্রে দুই সন্তান,স্ত্রী নিয়ে বাড়ি ছাড়ল শিবেন।সে শুধু ছেলেটাকে স্কুলে যাওয়ার ব্যবস্থাটুকু করে দিতে বলেছিল ঘোষাল মশাইকে।ঘোষাল মশাই বলেছিলেন,“জমিতে খেটে যদি রোজগার করতে পারিস তখন ছেলেকে স্কুলে পাঠাস”।শিবেন সারাদিন মাঠে–ঘাটে পড়ে থেকে যতটা সম্ভব উপার্জন করে ছেলের পড়াশোনা বজায় রেখেছে।সেদিন অন্নপূর্ণা দেবী বললেন,“হ্যাঁ,গো আমার ইচ্ছা মেয়েটাও একটু লেখাপড়া শিখুক।একটু অক্ষরজ্ঞান হবেনা মেয়েটার?লোকে মুখ্যু বলবে যে”।
শিবেন,“ইচ্ছা তো আমারও গিন্নী।কিন্তু আমাদের এত টাকা কই?কোনোমতে চেয়েচিন্তে ছেলেটাকে পড়াচ্ছি।সংসারের এই দশা”।
অন্নপূর্ণা দেবী,“আজ একবার ঘোষাল গিন্নী কে বলে দেখব”?
শিবেন সন্দেহের সুরে বলল,“ওরা কি আর সাহায্য করবে?আবার হয়ত অপমান করবে।তুমি কিছু বলতে যেও না”।
অন্নপূর্ণা দেবী নিষেধ শুনলেন না।দুপুরে বাড়ি পরিষ্কার করতে গিয়ে অন্নপূর্ণা দেবী ঘোষাল গিন্নীকে বললেন,“দিদি লক্ষ্মীকে যদি ম্যাট্রিকটা পাশ করাতে পারতাম”.......
ঘোষাল গিন্নী তখন দুপুরের খাওয়া সবে শেষ করে পানের বাটায় পান সাজতে বসেছেন।অন্নপূর্ণা দেবীকে কথা শেষ না করতে দিয়েই বললেন,“মেয়েমানুষের অত লেখাপড়া কি বাপু ! বাড়ির কাজ-কর্ম গুলো ভালো করে শেখা নইলে পরের বাড়ি গিয়ে বাপ–মার মুখ হাসাবে তো”।
অন্নপূর্ণা দেবী আর কিছু বলতে পারলেন না।শুধু আড়ালে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছলেন।তার স্বপ্ন পূরণ হওয়া যে প্রায় অসম্ভব তা সহজেই অনুমান করেছিলেন হয়ত।
দিনটা ছিল রবিবার।তখনও রামু ঘুম থেকে ওঠেনি।লক্ষ্মী ঘরে এসে বলল,“এই ভাই ওঠ বেলা হল যে”।রামু পাশ ফিরে বালিশে মুখ লুকালো।লক্ষ্মী আবারও ডাকল,“এই আজ বাড়িতে নাকি লোকজন আসবে মা বলল।কেন রে”?
রামু বালিশ থেকে চোখ তুলে মুচকি হেঁসে বলল,“তোর বিয়ে তাই তোকে দেখতে আসছে হয়ত”।এই বলে রামু ছুটে পালাল।
লক্ষ্মী,“দাঁড়া বদমাশ ছেলে,তোর হচ্ছে আজ”।এই বলে সেও ভাইয়ের পিছনে দৌড়ালো।হেঁসেল থেকে অন্নপূর্ণা দেবী বললেন,“কি রে তোরা কি শুরু করলি?বাড়িতে লোকজন আসবে”।রামু ছুটে এসে মায়ের আঁচল ধরে জিজ্ঞাসা করল,“কারা আসবে মা”?
অন্নপূর্ণা দেবী,“ওই পাশের গ্রামের জয়ন্ত ঠাকুরপোর ছেলে শহর থেকে লেখাপড়া শেষ করে এসেছে।ওর বাবা কে নিয়ে আসবে আজ।তোর বাবার সঙ্গে কি যেন কথা আছে।ওদের সামনে তোরা দুটিতে শান্ত হয়ে থাকিস”।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বাইরে শিবেনের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল,“কই গিন্নী কোথায় গেলে?জয়ন্ত এসেছে”।
অন্নপূর্ণা দেবী মাথায় ঘোমটা টেনে আড়াল থেকে বললেন,“ওদেরকে দাওয়ায় বসাও আমি আসছি”।
অন্নপূর্ণা দেবী,“রামু বাবা যা মাদুর আর মোড়া টা দিয়ে আয়”।
জয়ন্ত বাবু এবং তার ছেলে প্রবীর আসন গ্রহণ করলেন।
প্রবীর,শিবেনের উদ্দেশ্যে বলল,“কাকাবাবু গ্রামের অনেক লোকের সঙ্গেই আমার এই বিষয়ে কথা হয়েছে।শুধু আপনার সঙ্গে কথা বলা হয়নি”।
শিবেন,“হ্যাঁ,বাবা বলো কি বলতে চাও”।
প্রবীর,“কাকাবাবু আমাদের এবং আশেপাশের গ্রামের এমনকি বাবার কাছে শুনলাম আপনাদেরও জমি,জায়গা নৃপেণ ঘোষাল অতিরিক্ত সুদের অজুহাতে দখল করেছে।আমি অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেছি,আমি জানি সুদ কি ভয়াবহ পরিণতি আনতে পারে।আমরা সাধারণত জানি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধের শর্তে কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য বা অর্থের বিপরীতে পূর্ব নির্ধারিত হারে যে বেশি পরিমাণ পণ্য বা অর্থ আদায় করা হয়, সেটি
‘সুদ’।কাকাবাবু সমাজে শোষণের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম হচ্ছে সুদ। একদল লোক বিনা শ্রমে অন্যের কষ্টার্জিত উপার্জনে ভাগ বসায় সুদের সাহায্যেই।ঋণগ্রহীতা যে কারণে টাকা নেয়, সে কাজে তার লাভ হোক বা না হোক, তাকে সুদের অর্থ পরিশোধ করতেই হয়। ফলে অনেক সময় সুদ পরিশোধ করার জন্য ঋণগ্রহীতাকে তার বেঁচে থাকার সর্বশেষ সম্বলটুকুও বিক্রি করে দিতে হয়। ফলে ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পায়।গরিব কৃষকেরা বিভিন্ন সুদভিত্তিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে কৃষিকাজ করে থাকেন। কিন্তু অনেক সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা অন্য কোনো কারণে আশানুরূপ ফসল পাওয়া যায় না। তখন নির্দিষ্ট সময়ে সুদসহ মূলধন ফিরিয়ে দিতে না পারলে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান কৃষকের সহায়-সম্পত্তি দখল করে নেয় এবং নিলামে তুলে বিক্রি করে দেয়। এভাবে কৃষকেরা ভূমিহীন হয়ে পড়ায় কৃষি খাতে উৎপাদন কমে গিয়ে দেশের অর্থনীতি বিপদের মুখে পড়ে।সুদের কারণে অর্থনৈতিক শ্রেণিবৈষম্যের সৃষ্টি হয়। ধনীরা আরও ধনী হতে থাকে, গরিবেরা গরিব হতে হতে একপর্যায়ে চরম অসহায়ত্বের পর্যায়ে চলে যায়। এর ফলে অনেকে আত্মহত্যা কিংবা বিভিন্ন অসামাজিক কর্মকাণ্ড ও অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা হচ্ছে,পুঁজি মুষ্টিমেয় লোকের মাঝে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না। কারণ এর ফলে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা চরমভাবে ব্যাহত হয়।ধন-ঐশ্বর্য যেন কেবল বিত্তশালীদের মধ্যেই পুঞ্জীভূত না হয়।কিন্তু সুদের ফলে পুঁজি মুষ্টিমেয় লোকের মধ্যে আবর্তিত ও বৃদ্ধি পেতে থাকে। এতে একশ্রেণির মানুষের সম্পদ বিনা শ্রমে, বিনা উৎপাদনে বৃদ্ধি পেতে থাকে, আরেক দিকে গরিব মানুষেরা প্রয়োজনীয় উৎপাদনের জন্য অমানুষিক শ্রম সত্ত্বেও দিন দিন আরও গরিব হতে থাকে”।
শিবেন,“তাহলে এই অভিশাপ থেকে সমাজকে মুক্ত করার উপায় কি প্রবীর”?
প্রবীর,“উপায় আছে কাকাবাবু।যেমন ধরুন
অংশীদারিত্ব ব্যবসা,এতে একজনের মূলধন থাকবে এবং অন্যজন ব্যবসায়ে কাজ করবে। আর এভাবে অর্জিত লভ্যাংশ উভয়ের মধ্যকার চুক্তি অনুসারে পাবে। তবে ব্যবসায়ে ক্ষতি হলে মূলধন বিনিয়োগকারীর ওপর বর্তাবে। আর শ্রমদাতার ওপর ক্ষতির ভাগ বর্তাবে না,যেহেতু তার কষ্ট ও শ্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই সে অর্থের ক্ষতির অংশীদার হবে না।এছাড়াও অন্য উপায়ও আছে মূল্য নগদ পরিশোধ আর বস্তু বাকীতে বেচাকেনা অর্থাৎ,কারো নগদ অর্থের বিশেষ প্রয়োজন দেখা দিলে সে উক্ত জিনিসের উৎপাদনের সময় আসার আগে উপযুক্ত মূল্য নির্ধারণ করে এবং অর্থশাস্ত্রে বর্ণিত শর্তানুযায়ী পণ্যের আদান প্রদান করবে।এছাড়াও বাকীতে পণ্যের আদানপ্রদান করা যায়।নগদ বিক্রি মূল্যের চেয়ে বাকীতে বেশি মূল্যে পণ্য বিক্রি করা যায়।মানুষের সুবিধার্থে এবং সুদের লেনদেন থেকে মুক্ত হতে পণ্যের আদান প্রদান বৈধ।বিনা লাভে ঋণ প্রদানের জন্য নানা ধরনের সংস্থা গঠন করা আবশ্যক।ব্যক্তি বা সমষ্টি বা সরকারী বা বেসরকারী যেকোনো ধরণের সংস্থাকে এ ঋণের জন্য উৎসাহিত করতে হবে;যেন মানুষের মধ্যে পরস্পর সামাজিক সহযোগিতা ও দায়ভার বাস্তবায়িত হয়।ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে, অভাবী মানুষকে,বিপদগ্রস্ত পথিক প্রভৃতি অভাবী মানুষের প্রয়োজন মেটাতে, তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে সমাজের প্রত্যেকটি মানুষকে নিজ স্বার্থ উপেক্ষা করে নিজ সাধ্যমত মুক্ত হস্তে দানের জন্য এগিয়ে আসতে হবে।কাকাবাবু নৃপেণ ঘোষাল দিনের পর দিন যে অন্যায় করে চলেছে তা মেনে নেওয়া যায় না।আমাদের এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেই হবে।এই গ্রামের সবাই আমাদের পাশে আছে বলে কথা দিয়েছে।আপনার কি মত সেটিই জানতে এলাম কাকাবাবু”।
প্রবীর উৎসুক চাহনিতে শিবেনের দিকে তাকিয়ে থাকে।
শিবেনের কপালে চিন্তার ভাঁজ।সে বলল,“দেখো বাবা আমরা তো ঘোষাল মশাইয়ের দয়ায় বেঁচে আছি।আমরা সাধারণ মানুষ ওনার বিরুদ্ধে যাওয়া কি আর আমাদের মানায়”?
প্রবীর,“কাকাবাবু আপনি কীসের দয়ার কথা বলছেন?আপনাদের সর্বস্ব অন্যায় ভাবে আত্মসাৎ করেছে।আপনাদের মতন কত মানুষকে রাস্তায় এনে দাঁড় করিয়েছে। এরপরেও আপনারা চুপ করে থাকবেন?আপনারা যদি আমার পাশে থাকেন আমরা একসাথে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নৃপেণ ঘোষালের বিরুদ্ধে নালিশ করব।ও ঠিক শাস্তি পাবে”।
শিবেন,“তবে তাই হোক গ্রামের সবাই যখন চাইছে এর একটা বিহিত হোক তখন আমার কোনো আপত্তি নেই।আর জমি,বাড়ি সব ফিরে পেলে আর একটু ভালোভাবে বাঁচতে পারি বাবা।এভাবে যে আর চলা যায় না”।
এমন সময় অন্নপূর্ণা দেবী চা আর বাটিতে নারকোল নাড়ু নিয়ে এলেন।জয়ন্ত বাবু বললেন,“এই যে বৌঠান কেমন আছো”?
অন্নপূর্ণা দেবী,“এই এতদিন পর আমাদের কথা মনে পড়ল”?
জয়ন্ত বাবু,“না গো বৌঠান শিবেনের সঙ্গে প্রায় দেখা হত।সব খবরই আমি পেতাম।প্রবীর ফিরেই ওর পরিকল্পনার কথা বলল।তাই ওকে নিয়েই চলে এলাম”।
অন্নপূর্ণা দেবী,“ভালো করেছ ঠাকুরপো।মা মরা ছেলে।সেই কোন ছেলেবেলায় দেখেছিলাম।এত বড়ো হয়ে গেল।আমাদের এমনই দশা একটু যে ছেলেটাকে ভালো রেঁধে খাওয়াব তারও উপায় নেই”।
কথাগুলো বলতে বলতে অন্নপূর্ণা দেবীর চোখ ঝাপসা হয়ে এল।তিনি শাড়ির আঁচলে চোখ মুছলেন।
জয়ন্ত বাবু,“বৌঠান এবার আমাদের সকলেরসুদিন ফিরবে দেখো।অত্যাচারী এবার শাস্তি পাবে।বৌঠান যদি অভয় দাও একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?ফিরিয়ে দিতে পারবে না কিন্তু”।
অন্নপূর্ণা দেবী,“আমার কি আছে যে তোমাকে ফিরিয়ে দেব ঠাকুরপো।বলো কি বলবে”।
জয়ন্ত বাবু,“তোমার মেয়েকে আমার ঘরের লক্ষ্মী করে নিয়ে যাব।নিয়ে যেতে দেবে”?
অন্নপূর্ণা দেবী যেন বিশ্বাসই করতে পারলেন না,“কি বলছ ঠাকুরপো।আমার যে এখন কিছুই নেই।মেয়ের বিয়ে দেব কি করে”?
জয়ন্ত বাবু,“সে সব তোমাদেরকে কিছু ভাবতে হবে না বৌঠান।আমার লক্ষ্মীকে ঘরে নিয়ে যাব এতে এত কিন্তু কিসের?আমার যা কিছু আছে তা তো আমার পুত্র আর পুত্রবধূরই থাকবে।তুমি শুধু অনুমতি দাও”।
শিবেন,জয়ন্ত বাবুর দু-হাত ধরে বলল,“আমরা রাজি ভাই।তুই যে আমাকে বাঁচালি।কন্যাদায় যে বড়ো দায়”।
জয়ন্ত বাবু,“আমি এবার নিশ্চিন্ত।এবার শুভদিন দেখে চার হাত এক করে দিলেই হল”।
প্রবীর এতক্ষণ আরক্ত মুখে চোখ নীচু করে বসে ছিল।এদিকে সকলের অগোচরে নব যৌবনে পদার্পণরতা এক তরুণীর লজ্জাশীল আরক্ত নয়ন ঘরের দরজা হতে আড়াল হল।
লক্ষ্মী ঘরে আসতেই রামু হাঁসি মুখে বলল,“দেখলি দিদি সকালে বলেছিলাম তোকে দেখতে আসছে”।
লক্ষ্মী,“চুপ কর পাকা ছেলে”।
এদিকে শিবেনের বাড়িতে যখন বহুদিন পর খুশির আমেজ তখন বিপদ বুঝি অপেক্ষা করছিল কোনো নতুন অভিপ্রায়ে।সেদিন সন্ধ্যেবেলা বাড়িতে-বাড়িতে তুলসিতলায় যখন শঙ্খধ্বনি শোনা যাচ্ছে।সেই মুহূর্তে নৃপেণ ঘোষালের বাড়ির পিছনের পুকুরের খিড়কি দরজা দিয়ে এক অজ্ঞাত ব্যক্তি প্রবেশ করলেন।তিনি গামছায় কোনপ্রকারে মুখ ঢেকে নৃপেণ ঘোষালের বৈঠকখানায় উপস্থিত হলেন।
নৃপেণ ঘোষাল,“এসো ব্রজেশ্বর।বহুদিন পর উদয় হলে যে”।
ব্রজেশ্বর,“আজ্ঞে কত্তা কিছু কথা ছিল।ভাবলাম আপনাকে আগেভাগে জানিয়ে রাখি”।
নৃপেণ ঘোষাল,“ওই জয়ন্তর ছেলেটা গ্রামের লোকজনকে আমার বিরুদ্ধে নিয়ে যাচ্ছে এই কথা তো”?
ব্রজেশ্বর,“আপনি জানেন কত্তা”?
নৃপেণ ঘোষাল,“ও রে হতভাগা আমি জানি বলেই আমি মনিব আর তুই চাকর।ওই ছোঁড়ার বিষ দাঁত কি করে ভাঙতে হয় তা আমার জানা আছে।শহর থেকে কদিন লেখাপড়া করে এসে নিজেকে কেও-কেটা ভাবতে শুরু করেছে”।
ব্রজেশ্বরের ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি খেলে গেল,সে বলল,“কত্তা তাহলে বিশু লেঠেল কে খবর দিই”।
নৃপেণ ঘোষাল,“না অহেতুক প্রাণী হত্যায় আমার কোনো স্পৃহা নেই।অন্য উপায়ে এই বিষয়টাকে সামলাতে হবে।যদি না হয় তখন অন্য রাস্তা”।
সেদিন সকাল থেকেই শিবেন ব্যস্ত ছিল।আজ প্রবীর গ্রামের সবাইকে নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছে যাবে।তাই শিবেন সকাল সকাল স্নান-খাওয়া সেরে নিয়েছে।লক্ষ্মীর দুদিন হল জ্বর।খুব সম্ভবত ম্যালেরিয়া।প্রবীর ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে বলেছে।ডাক্তার দেখানোর সামর্থ্য শিবেনের নেই।এখন প্রবীরই ভরসা।কিন্তু প্রবীরের আসতে এত দেরি হচ্ছে কেন?সকাল ১০ টার মধ্যে তার চলে আসার কথা।
অন্নপূর্ণা দেবী শিবেনকে বললেন,“একবার কাওকে জিজ্ঞাসা করে এসোনা প্রবীর এলো কি না।এদিকে মেয়েটার জ্বর বেড়েই চলেছে।এবার ওষুধ না হলে তো আর চলবে না”।
শিবেন,“হ্যাঁ যাই মন্ডল খুড়ো কে একবার জিজ্ঞাসা করে আসি”।
শিবেন চলে গেলে অন্নপূর্ণা দেবী লক্ষ্মীর শিয়রে এসে বসলেন।রামু কে তিনি দোকানে পাঠিয়েছেন দু-পয়সার সাবু আনতে।জ্বরের মুখে হতভাগীর তাই ভরসা।লক্ষ্মীর গতকাল রাত থেকে হুঁশ নেই।মাঝেসাঝে ভুল বকছে।কিছুক্ষণ পর শিবেন ফিরে এসে খাটের পাশে হতাশ মুখে বসে পড়ল।
অন্নপূর্ণা দেবী,“কি গো প্রবীরের খোঁজ পেলে”?
শিবেন,“সে বাবা কে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে ভেগেছে”।
অন্নপূর্ণা দেবী,“মানে,কি বলছ”?
শিবেন,“গতকাল বাগদি পাড়ার শ্যামসুন্দর প্রবীর আর জয়ন্ত কে ঘোষাল মশাইয়ের বাড়ির দিকে যেতে দেখে ওদের পিছু নেয়।ঘোষাল মশাইয়ের বৈঠকখানার জানলাটা রাস্তার দিকে পড়ে।সেই জানলার আড়ালে দাঁড়িয়ে শ্যামসুন্দর,প্রবীর আর জয়ন্ত কে টাকা নিতে দেখেছে ঘোষাল মশাইয়ের কাছ থেকে।এবার বুঝতে পারছ গিন্নী প্রবীর কিভাবে আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করল”।
অন্নপূর্ণা দেবী কাতর স্বরে বললেন,“এবার আমাদের কি হবে গো।আমাদের মেয়েটা কে ডাক্তার দেখাব কি করে”?
শিবেন,“যাই ঘোষাল মশাইয়ের কাছে পায়ে, হাতে ধরে যদি কিছু টাকা আনতে পারি”।
অন্নপূর্ণা দেবী,“তাই যাও মেয়েটাকে বাঁচাও তোমার দুটি পায়ে পড়ি”।
শিবেন কে দেখেই নৃপেণ ঘোষাল চেঁচামেচি শুরু করলেন,“ব্যাটা ছোটলোক,আমার খাবি আবার আমারই বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবি।আবার টাকা চাইতে এসেছে।যা দূর হ”!
শিবেন অপমান সহ্য করতে না পেরে বাড়ি ফিরে এলো।
অন্নপূর্ণা দেবী বললেন,“হ্যাঁ গো এবার কি হবে”?
শিবেন,“মায়ের দেওয়া কাঁসার থালা,বাসন গুলো বার করে আনো।ওগুলোই এখন ভরসা।আজ বিকেলে গঞ্জে চলে যায়।বিক্রি করে কাল সকালের মধ্যে ফিরে লক্ষ্মীকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো”।
শ্বাশুড়ি মায়ের শেষ স্মৃতি বাসন গুলো তোরঙ্গ থেকে বের করার সময় অন্নপূর্ণা দেবীর চোখ ঝাপসা হয়ে এলো।সেদিন অভাবগ্রস্ত এক গ্রাম্য বধূর ব্যাকুল হৃদয় নতজানু হয়ে তার স্বর্গত
শ্বশুর কূলের প্রতি বারংবার ক্ষমা প্রার্থনা করেছিল।ব্যাকুলতা,দারিদ্রতা এবং অভাবের ফলস্বরূপ সেই অশ্রুর সাক্ষী ছিলেন একমাত্র জগদীশ্বর।শিবেন গঞ্জে বেরিয়ে যাওয়ার পর বৈশাখের বিকেলের আকাশে কালো মেঘ ঘনিয়ে এলো।রাতে ঝড়–জলের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে লক্ষ্মীর জ্বরের মাত্রাও বাড়তে থাকে।পরদিন শিবেন গঞ্জ থেকে ফেরার পূর্বেই লক্ষ্মী অভাবের গ্লানি হতে মুক্তি পেয়ে চির শান্তির জগতে আশ্রয় পেয়েছে।শুধু পড়ে আছে উজানপুর গ্রামের এককোণে তাদের একচালা ঘর,সদ্য কন্যা বিয়োগের শোকে আচ্ছন্ন হতভাগ্য পিতা–মাতা।আর আছে তার একমাত্র খেলার সাথী তার ভাই রামু।সে এখন প্রায় ব্রাহ্মণী নদীর ধারে বাঁধানো ঘাটে বসে রাতের আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখে।তার মা তাকে বলেছে দিদি নাকি তারা হয়ে গেছে।আকাশের পানে চেয়ে থাকতে থাকতে অজান্তেই একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে তার নয়ন বেয়ে।ছোট্ট হাতে চোখের জল মুছে রামু জোৎস্না রাতে বাড়ি ফেরার পথ ধরে।এইআমবাগান,ওই নদী,নদীর ধারের কাশফুলের ঝোপ,উলুখাগড়ার বন,এই গ্রামের আকাশ-বাতাস সব জায়গায় তার দিদি কে খুঁজে পাই রামু।এখন তার আর একা লাগে না।