‘বেশরম’ বাৎসায়ন
দিব্যেন্দু ঘোষ
কৃষ্ণ করলে লীলা, আমরা করলে বিলা?
উঁহু, সেটি হচ্ছে নে। কামনা-বাসনার অত্যাধুনিক আবেদনমথিত রাসমঞ্চে খিলাড়িকুল লীলায়িত আকাঙ্ক্ষায় হাপুস হুপুস শব্দে গোগ্রাসে পরম সাধের ফলমূলাদি গলাধকরণ করবেন আর অর্গাজমে সেঁকে নেবেন সঙ্গীসাথীর অনভিপ্রেত কাম, আর আমাদের লুক্কায়িত দুই চোখ সেই পাড়ায় রসাস্বাদিত ভ্রমণ সম্পন্ন করবে না, তা কি হয়? শরীরে শরীর ঘষলে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে বাসনা, কামের কপাল বেয়ে মৃদু ছন্দে গড়িয়ে পড়া বিন্দু বক্ষ বিভাজিকায় এসে টলমল করে ওঠে, পিছলে নামে নাভিকুণ্ডে, শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, তাই তো তার নাম নাভি-শ্বাস।
কত শত এমনতরো নাভি-শ্বাসে দম আটকে বেদম সবসে বড়া খিলাড়িকুল। সুইডেন সেক্স ফেডারেশনের টুইটার হ্যান্ডেলে আঙুলের টোকা দিয়ে দেখছিলাম, সুদূর ইউরোপের রাস, থুড়ি লীলামঞ্চের রাশ আলগা করা যায় কি না। যা দেখলাম, তাতে গোপন কথাটি রইল না গোপনে।
কী বলেন রক্ষণশীল সমাজবিশারদরা? ধুর, ওদের মত জানতে বয়েই গেছে। কোঁকড়ানো সোনালি চুল, কপালে কালো বিন্দুর মতো টিপ, চোখে মাশকারা, নাকে একচিলতে হিরের নথ, নাকের পাটাতনে বিন্দু ঘাম, লাল টুকটুকে ঠোঁটযুগল, নাক আর তিরতির করে কাঁপতে থাকা ঠোঁটের মধ্যিখানে টলটল করা দুফোঁটা ঘাম, কানে উজ্জ্বল পলাশরঙা টুকরো পাথরের কানছাবি, কাঁধ বেয়ে হালকা নামা চুলের রাশি, দুই ভীরু নরম কবুতরের মতো স্তনদ্বয় পাতলা ফিনফিনে একচিলতে কাপড়ে ঢাকা, নীচে পিছলে পড়া রুপোলি আভা, নরম পেটের সপাট তটভূমিতে জেগে থাকা এক গভীর রহস্য, খোলা কোমরে সোনার কোমরবন্ধ, নীচে আরও নীচে মনোরম জল-জঙ্গলের কাব্যিক ছন্দ। ঈশ্বরের যে এমনই সৃষ্টি, রহস্য থাক, রহস্যভেদী বাণ থাক বা না-থাক, গমরঙা উরু বেয়ে গড়িয়ে নামতেই হবে লিপ্সার জলতরঙ্গ। এমন মখমলি আঙুলে পরা
থাক রুপোর আংটা, সেই আংটা ছুঁয়ে পুষ্টু গোড়ালি বেয়ে উঠে কোথায় যেন হারিয়ে যায় দুচোখ, খুঁজতেই থাকে পড়ন্ত বিকেলের গোধূলি-রঙা নিতম্ব পেরিয়ে সতীপীঠ মাহাত্ম্য।
সুইডেন কি বোঝে এ মাহাত্ম্য?
জানতে অনেকটা পিছনে ফিরে গিয়েছিলাম। অধ্যাপক হারাণচন্দ্র চাকলাদারের মতে, বাৎস্যায়ন দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতের অধিবাসী ছিলেন। কামসূত্রে ভারতের প্রায় সব অঞ্চল সম্পর্কে অল্পবিস্তর আলোচনা থাকলেও দক্ষিণ-পশ্চিম ভারত সম্পর্কে লেখকদের ব্যাপক এবং গভীর ধারণা লক্ষ্য করা যায়। শ্যামশাস্ত্রীর (কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের সম্পাদক) ধারণা, বাৎস্যায়ন ১৩৭-২০৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোনও এক সময়ে জন্মেছিলেন। অধ্যাপক হারানচন্দ্র চাকলাদার এ সমস্যাটি নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, কামসূত্র ৪০০ খ্রিস্টাব্দের আগে লেখা হয়েছে এবং সেটা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র এবং
পতঞ্জলির মহাভাষ্য-র পরে, কেননা বাৎস্যায়ন এ দুটি গ্রন্থ দ্বারা কমবেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন। অতএব, ধরে নেওয়া যেতে পারে, খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ থেকে খ্রিস্টাব্দ ৩০০-র মাঝে কোনও এক সময়ে বাৎস্যায়ন কামসূত্র লিখেছিলেন। কামসূত্রে অভিজাত শ্রেণির ভোগ-বিলাস এবং আভিজাত্যের ফিরিস্তি থেকে অনুমান করা যায়, এ ধরনের লেখা তখনই সম্ভব যখন রাষ্ট্র ছিল সমৃদ্ধশালী, নগরবাসীরা ছিল ধনবান এবং বিলাস-ব্যসনে মশগুল। সন্দেহ নেই, সময়টা ছিল সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং ওই জনপদ ছিল কোনও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা এবং বিদেশি আগ্রাসন থেকে মুক্ত। গুপ্ত যুগ (৩০০-৩০০ খ্রিস্টাব্দ) ছিল এমনই একটা সময় যখন শিল্পকলা এবং সাহিত্য চর্চা সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছিল। যৌনতার প্রতি ভারতীয়দের উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলে ফেলার জন্য খ্রিস্টান মিশনারি, ইংরেজ প্রশাসন ভারতের শৃঙ্গাররস-কেন্দ্রিক সাহিত্য, শিল্পকলা, অভিনয় এবং সঙ্গীতের প্রতি অশ্লীলতার অভিযোগ এনে এর নিয়ন্ত্রণ শুরু করে। একটি আইন
(Obscene Publication Act) প্রণয়ন করে এই ধরনের সাহিত্যকর্মের প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে দেয়। ফলে, ভারত উপমহাদেশে দুহাজার বছর ব্যাপী প্রবহমান কামশাস্ত্রের চর্চা উনিশ শতকে এসে ব্যাহত হয়। তখন থেকেই এই সাহিত্যধারার প্রতি ভারতীয়দের, বিশেষত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে শুরু করে। প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃত সাহিত্যে মালঙ্গ বাৎস্যায়নের কামসূত্র একটি কালজয়ী গ্রন্থ। নারী ও পুরুষের দাম্পত্য জীবন, কামকলা, অভিজাত শ্রেণীর সংস্কৃতি এবং আমোদ-ফুর্তি নিয়ে এই বই দুহাজার বছর ধরে পাঠকদের আকৃষ্ট করে রেখেছে। ১৮৭৬ সালে রিচার্ড ফ্রান্সিস বার্টন, ভগবানলাল ইন্দ্রজি, ফস্টার ফিটজজেরাল্ড আর্বাথনট এবং শিবরাম পরশুরামের সম্মিলিত চেষ্টায় কামসূত্র-র ইংরেজি অনুবাদ হয়। পাশ্চাত্যে বইটি ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা লাভ করে। সংস্কৃতে কাম-এর অর্থ বাসনা, প্রেম, আনন্দ এবং যৌনক্রিয়া। অর্থাৎ পঞ্চ-ইন্দ্রিয়লব্ধ যে কোনও আনন্দই কামের আওতাভুক্ত। আর সূত্র-র অর্থ কোনও
নীতি বা তত্ত্বের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা। কামসূত্র শুধুমাত্র যৌনতার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, প্রাচীন ভারতের সমাজ জীবনের বিভিন্ন বিষয়ের বিস্তারিত এবং বাস্তবধর্মী তথ্যের সমাবেশ ঘটেছে এখানে। এছাড়া বাৎস্যায়ন কমবেশি মনোবিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব, যৌন বাসনা, সমকামিতা, ভেষজ চিকিৎসা এবং নারী যৌনকর্মীদের পেশাগত দক্ষতার উন্নয়ন নিয়েও পরামর্শ দিয়েছেন। মূলত, কামসূত্র প্রাচীন ভারতের মৌর্য এবং গুপ্ত সভ্যতার ৮০০ বছরের শিল্প-সংস্কৃতির একটি লিখিত প্রমাণ। প্রাচীনকাল থেকে ১৮ শতক পর্যন্ত ভারতে কামশাস্ত্রের চর্চা অব্যাহত ছিল। কিন্তু ভারতে ইংরেজ শাসনকালে এই পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে যায়। তবে আধুনিক বিশ্বে যৌনচর্চার ধারণাটাই আমূল বদলে যায়। যৌনতা এখন আর শুধুমাত্র চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি নেই।
লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়া রাখিনু/তবু হিয়া জুড়ন না গেল। চণ্ডীদাস পড়ে কবি নির্মলেন্দু
গুণ লিখেছেন,
চণ্ডীদাস ছিলেন বড় কবি, তবে/উনার পড়া হয় নাই বাৎস্যায়ন/আমি তাকে একলব্যের মতোন/খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে করেছি অধ্যয়ন।/তারই কল্যাণ্যে নারীকে চিনেছি/শিখেছি সঙ্গমকলা, রতিরঙ্গরস,/তা না হলে সকলি গরল ভেল/কামসিদ্ধি বিনা ব্যর্থ কাব্যযশ।/আমি একবারই পেয়েছি তাহারে,/জুড়িয়েছি লাখ বর্ষ, লক্ষ জীবন।/
বাৎস্যায়ন হোক বা চণ্ডীদাস কিংবা নির্মলেন্দু গুণ, তাঁদের লেখা বা কবিতা বোধহয় ওরা পড়েনি। ওরা মানে দক্ষিণ-পশ্চিম সুইডেনের গোথেনবার্গের এক গোপন বিলাসী কুঠুরিতে যারা আসঙ্গ লিপ্ত ছিল সেরা হওয়ার প্রতিযোগিতায়। এ লেখা লিখতে গিয়ে কতবার যে শ্রদ্ধেয় কবি নির্মলেন্দু গুণের শরণাপন্ন হতে হয়,
আমি চাই তুমি/আমাকে শ্রবণ কর/আমাকে
দ্রবণ কর/তোমার ভিতরে।/তুমি জয় কর দ্বিধা,/জয় কর সংশয়।/মনে রেখ এই দেহ/কমলালেবুর মতো/পচনপ্রবণ, এই দেহ/আর কারও নয়-/তুমি শুধুই আমার।
ব্রিটনের বার্বি সিনস, রাশিয়ার মলি ডেভন, স্লোভেনিয়ার মিস্টার রিডল, ফ্রান্সের লরেঞ্জা ভিয়োটা, ইউক্রেনের তালিয়া মিন্ট, ইতালির এরিক ক্যাপিটানো, রোমানিয়ার মুগুর, গ্রিসের নেক সিনার, ক্রোয়েশিয়ার সুইট মেরি, ফিনল্যান্ডের অ্যান জয়, ইউক্রেনের ম্যাথু মেয়ার, পর্তুগালের সেক্সি লেক্সি, স্পেনের সেলভা ল্যাপিড্রারা গোথেনবার্গের সেই গভীর গোপনে উচ্চস্বরে নির্মলেন্দু গুণ আওড়াচ্ছিলেন আর জিভা সেভেডিচিকের মতো বিচারকরা সেই অসীম শৃত্কারে রতিরসের উত্স খুঁজে প্রতিযোগীদের নম্বর দিচ্ছিলেন। শিহরণের রসে জারিত হল আকণ্ঠ নাভি-শ্বাস। উথাল-পাথাল অঙ্গরসে ভিজল সুমধুর দিন-রাত, রমণী, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছো, রমণে পটু পুরুষ জিজ্ঞাসিল ওই মখমলি বিছানায়, দীর্ঘায়িত হল
সঙ্গমকাল, কোনও পুরুষ বা নারী নয়, বিজয়ী হল বিশ্বের প্রথম সেক্স চ্যাম্পিয়নশিপ। চু্ম্বনের প্রকারভেদে রসাস্বাদিত হল তৃষিত হৃদয়। তিষঙ্ক, উদভ্রান্ত, অঘপীড়িতক, অবপীড়িতক, কর্ষণ চুম্বন, উত্তর চুম্বন, সম্পূট চুম্বন, অন্তর্গত মুখ চুম্বন, চলিতক, প্রতিরোধক, সভৌষ্ঠ চুম্বনে সুইডেন সম্ভোগবেষ্টিত সাধনে সিদ্ধিলাভ করল। তবে বেশ কয়েকটি নামকরা সংবাদ মাধ্যম যেমন রয়টার্স, স্নোপস, ম্যাশেবল, দ্য কুইন্ট, ডয়চে ভেলে পরে দাবি করে, সুইডিশ ভাষার একটি বিশিষ্ট দৈনিক সংবাদপত্র গোটেবর্গস পোস্টেনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ড্রাগন ব্রাটিক নামে এক সুইডিশের জড়িত থাকার বিষয়টি উঠে আসে। বেশ কয়েকটি স্ট্রিপ ক্লাবের মালিক এই ব্র্যাটিক। তিনি এই ধরনের একটি খেলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। একটি সেক্স ফেডারেশন তৈরি করতে চেয়ে সুইডিশ স্পোর্টস কনফেডারেশনের সদস্য হওয়ার জন্য একটি আবেদন জমা দেন। কিন্তু সেই আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়। তার পরেই সেক্স চ্যাম্পিয়নশিপের খবর দিকে দিকে রটি যায়
ক্রমে।
[তথ্যসূত্র : হারানচন্দ্র চাকলাদারের ‘বাৎস্যায়ন- কামসূত্রের লেখক : তারিখ এবং উত্সের স্থান,’ জার্নাল অফ লেটারস অফ ডিপার্টমেন্ট কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ডয়চে ভেলে, রয়টার্স]