কেশবতী ও কদমফুল
ঈপ্সিতা মাইতি
খোলা জানালা দিয়ে হাঁ করে বাইরেটা দেখছিল ঝুমুর। আকাশ মেঘলা। বৃষ্টি নামবে যে কোন মুহূর্তে। হঠাৎ খেয়াল হল কদম গাছটায় ফুল ফুটেছে।সবুজ বড় পাতার মাঝে থোকা থোকা সাদা -হলুদ কদম। ছিল একটা, তাদের দেশের বাড়িতে। সবুজ ঘাসের মাঠে প্রায়ই ঝরে পড়ত একটা দুটো কদম ফুল। ছোট বোন নুপূর বলত, লাড্ডু। ও বলত, সূর্য। কত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেল ওরা! দুই বোন যেন দুই মেরু। অথচ মাত্র এক বছরের ছোট বড়।
দরজা খোলার শব্দ হল। দ্রুত হেঁটে ঢুকছেন ড:প্রতিম দেববর্মণ,প্রখ্যাত অঙ্কোলজিস্ট, ঝুমুরের প্রতিম দা। গম্ভীর মুখে নার্স মেয়েটির সাথে কথা বলছেন।ব্যস্ত হাতে উইগ খোঁজে ঝুমুর। ঝুরি ঝুরি করে কাটা সাদা -কালো চুলে কদম ফুল হয়ে আছে মাথাটা। কেমো চলছে তো। উইগটা কোথায় যে রেখেছে ছাই! লম্বা চুলের মেয়েদের ওপর প্রতিমদার দারুণ ইনফ্যাচুয়েশন, সেই কবে থেকে জানে ঝুমুর।ওর প্রথম প্রেম বলে কথা! অবশ্য একতরফা।ছোট মফস্বল শহরের একই পাড়া, একই স্কুল। প্রতিমদা উজ্জ্বলতম ছাত্র। ঝুমুর পড়াশোনায় মধ্যমেধা,কিন্তু হৃদয়বান, ঘরোয়া,শান্ত।নুপূর
ছিল খুব মেধাবী আর সপ্রতিভ।নিজের টা বুঝে নিতে জানত। আর ওটাই পেরে উঠত না ঝুমুর। তাই হয়তো নুপূর প্রেম পেল, ঘর-সংসার পেল, চাকরি পেল, ডানা মেলে উড়ে গেল আটলান্টিকের ওপারে।মাঝে মাঝে ভিডিও কলে কথা হয়। নুপূরের বয়স যেন কমছে দিন দিন। কালো নদীর মত একঢাল চুল কবেই কেটে ফেলেছে। এখন ওর মাথা জুড়ে বাদামি -রূপোলি ঢেউ। জীবন জুড়েও। সেই ঢেউতে ভেসে আসে উত্তরোত্তর সফলতার ঘ্রাণ।
ঝুমুর গো-হারান হেরে গেছে,সব দিক থেকেই। দায়িত্ব -কর্তব্য পালন, টাকা পয়সার টানাটানি, উদয়াস্ত পরিশ্রম ,এই মারণরোগ আর উপেক্ষা,অভিমান - মোটামুটি এই দিয়ে ভরা তার প্রাপ্তির ঝোলা।
ঝুমুরের অস্থিরতা চোখ এড়ায় না প্রতিমের। কত ছোটবেলা থেকে চেনেন মেয়েটাকে।নুপূর আর ঝুমুর পিঠোপিঠি,তবু কত ফারাক। নুপূর তাঁর হৃদয় নিয়ে ছেলেখেলা করেছে। আর ঝুমুর... আসলে নুপূর- নিক্বণে মোহিত তিনি
সেভাবে খেয়াল করেন নি।তবে ও...মানে ওর চোখদুটো বড় মায়াভরা ছিল।বড় ভালো মনের মেয়ে,সবাই জানে। ছোটোখাটো একটা চাকরি করে। বিয়ে-থাও করল না।তার ওপর এই রোগ। মা বলেছেন বলেই কেসটা হাতে নিয়েছেন তিনি।তাঁর তত্বাবধানে নামমাত্র খরচে চিকিৎসা চলছে।নুপূর কি জানে এসব কথা? কে জানে!নুপূর আজও হৃদয়ে কোথাও থেকেই গেছে, পুরনো চিনচিনে ব্যথার মত।
ঝুমুরের খুব কাছে এসে বসেন প্রতিম।হাত রাখেন ওর মাথায়। ছোটবেলায় ওর উলোঝুলো একমাথা চুল ছিল।যত্ন করত না একদম। নুপূরের সম্পূর্ণ বিপরীত।কদম ফুলের মত ঝিরঝিরে চুলে ভরা ওর মাথাটা ছুঁয়ে আজ বড় কষ্ট হল তাঁর।মেয়েটা কি পেল জীবনে! সময় কি নিষ্ঠুর!টেনে হিঁচড়ে ঠিক পৌঁছে দেবে জীবনের শেষ দরজায়। ঝুমুরের শীর্ণ হাতদুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললেন, "তুই এমনিই সুন্দর, ঝুমুর, আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর মানুষ তুই"।
ঝুমুরের ঠোঁট চিলতে হাসিতে বেঁকে গেল। বড় বড় দুচোখ দিয়ে টপটপ করে দু ফোঁটা জল ঝরে পড়ল। "তোমাকে দেওয়া ডায়েরির পাতা ছিঁড়ে আমার বোনকে চিঠি লিখেছিলে, মনে পড়ে?লিখেছিলে,তোমার অপরূপ সুন্দর মুখশ্রী আমার ঘুম চুরি করেছে।তোমার উজ্জ্বল কালো যমুনার মত চুলের গহীনে ডুবে মরতে চাই। তোমার মত স্ফটিকস্বচ্ছ সুন্দর মনের মানুষ আমি কখনো... আমার না সব ছবির মত মনে আছে জানো। একটা সত্যি কথা বলবে? আমি আর বেশিদিন বাঁচবো না, তাই না, প্রতিম দা? তাই তুমি আজ শেষ পারানির কড়ি দিতে এসেছ। "
বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত উঠে দাঁড়ান প্রতিম। ধরা পড়ে যাওয়া মুখটা ফিরিয়ে নেন অন্যদিকে।কড়া ধাতের মানুষ বলে পরিচিত স্বনামধন্য ডাক্তারবাবুর চোখ কেন কে জানে ভরে ওঠে জলে।