আনন্দ গোপাল গরাই
আনন্দ গোপাল গরাই
মতির মা
গ্রামের এক প্রান্তে একটা কুঁড়ে টাঙ্গিয়ে থাকে অশীতিপর বৃদ্ধা সরোজিনী।অবশ্য নিজের নামে নয় ছেলের নামেই সবাই তাকে চেনে। ছেলে বুড়ো যুবক যুবতী সবাই তাকে মতির মা বলেই ডাকে। মতির মা শুনতে শুনতে নিজের নামটাই সে ভুলে গেছে কিনা কে জানে!
সে অনেক দিনের কথা। একজনই তাকে ডাকত নাম ধরে। সে তার স্বামী নিবারণ। তার মুখেই সে শুনেছে তার আদরের নাম সরো। কিন্তু সে দিন আজ আর নেই। কালের নিয়মে কোনোকিছুই চিরস্থায়ী থাকে না। নেই মতির মায়েরও। আজ তার মুখে বলিরেখার দাগ স্পস্ট। জড়ো জড়ো হয়ে গেছে গায়ের চামড়া। ঘোলাটে চোখ দুটো কোটরাগত। ভালো করে দেখতে পায় না। একটা অপারেশন করা চোখে সামান্য দেখে। গাঁয়েরই এক সহৃদয় ব্যক্তি ছানি অপারেশন ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে অপারেশন করিয়ে দিয়েছিল তার। অন্য চোখটারও অপারেশন দরকার ছিল। কিন্তু নানা কারণে করানো হয়নি।
সরোজিনীর রূপের টানে আশেপাশে ঘুর ঘুর করতো অনেকে। বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছিল বেশ কিছু বড়লোকের ছেলে। কিন্তু কাউকে পাত্তা দিতো না সে। অপেক্ষা করে থাকত তার সেই মনের মানুষের জন্যে যে সত্যিকারের তার মন বুঝবে, তাকে সত্যিকারের ভালোবাসা দেবে। এরকম মানুষ খোঁজার অনেক চেস্টা করেছে সে। কিন্তু সহসা দেখা মেলেনি। সে জানত যারা তার চারিপাশে ঘোরাঘুরি করছে তারা তার রূপটাকে ভালোবাসে--- মনটাকে নয়। তারা চায় শুধু তার শরীরটাকে—ঠিকরে পড়া যৌবনটাকে। পুরুষের আদিম লালসার প্রতিফলন দেখতে দেখতে অন্য মেয়ের মতো অভ্যস্ত হয়ে গেছে সরোজিনীও। আদিম লালসার সঙ্গে কেবলমাত্র পুরুষের নাম জড়িয়ে দিলে তাদেরকে ছোট করা হয়। নিজের লালসা চরিতার্থ করার জন্যে নারীরা কি পুরুষদেরকে টানে না? অবশ্যই টানে। তবে সব নারীর ক্ষেত্রে যেমন একথা খাটে না ,তেমনি সব পুরুষের ক্ষেত্রেও খাটে না। ভালোবাসার ইতিহাস খুঁজলে কত স্বর্গীয় প্রেমের কাহিনী যে উঠে আসবে সে সংখ্যাটা আকাশের তারা গোনার মতোই ধোঁয়াটে থেকে যাবে। প্রেমই তো মানুষকে করেছে মহীয়ান। তাকে দিয়েছে অন্তরের অন্তর্লোকে প্রবেশের ছাড়পত্র!
সরোজিনী চাইত এমন একটা মানুষকে যার উপর সারাজীবন ভরসা রাখা যায়। যাকে নিজের চেয়েও বেশি বিশ্বাস করা যায়। কিন্তু কেমন করে চিনবে সেই মানুষকে? কোথায় পাবে সেই মনের মানুষের সন্ধান! এই করতে করতেই জীবনের অনেকগুলো দিন পেরিয়ে যায় সরোজিনীর। একসময় বুঝতে পারে নিজের যৌবন নদীতে যেন ভাটার টান অনুভূত হচ্ছে। না , আর নয়। জীবনটাকে নিয়ে এই ছেলেখেলা করতে চায় না সে। এবার চাই তার সত্যিকারের একটা অবলম্বন। ঘটনাচক্রে পরিচয় হয় নিবারণের সঙ্গে। তবে এই মানুষটাকেও যাচাই করে নিতে চায় সে। নিবারণের মধ্যে সে আবিষ্কার করে এক মুগ্ধতা। সেই মুগ্ধতা তার রূপের জন্যে কিনা বুঝতে চেষ্টা করে সরোজিনী। নারীর রূপের প্রতি পুরুষের আকর্ষণ তো সহজাত ব্যাপার। কিন্তু সেই আকর্ষণের মধ্য দিয়েই জন্ম নেয় আর এক আকর্ষণ। যার নাম ভালোবাসা। রূপ মানুষের চিরদিন থাকে না। কিন্তু ভালোবাসা থেকে যায় জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। এই পাওনাটাই মানুষের সব চেয়ে বড় পাওনা—সবচেয়ে কাঙ্খিত বস্তু। যে জিনিষটা অনেকের মধ্যে খুঁজে পায়নি সরোজিনী তা পেয়েছিল নিবারণের মধ্যে। তাই তাকে নিয়েই ঘর বাঁধার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে। ঘরও বেঁধেছিল নিবারণকে নিয়ে।
একটা বেসরকারি অফিসে লোয়ার ডিভিসন ক্লার্কের চাকরি করত নিবারণ। বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে। ডেইলি যাতায়াতের কোন সুযোগ নাই। বাধ্য হয়ে অফিসেরই একটা ঘরে বাসা নিয়েছিল সে। ভাড়া অবশ্য লাগত না। ওটা নাইটগার্ডদের থাকার ঘর । ওই ঘরেই নাইটগার্ডের সঙ্গে থাকত নিবারণ। খেতোএকটা ছোটখাটো হোটেলে খুব কমখরচায়। নাইটগার্ডের ভীষণ পছন্দ নিবারণকে। হবে নাই বা কেন? ফ্রিতে একজন সাথী পেলে কে না খুশি হয়! শনিবার সন্ধ্যায় বাড়ি আসত নিবারণ। রবিবারটা থেকে সোমবার আবার চলে যেতে হতো তাকে। সরোজিনী থাকত তার শাশুড়িমায়ের কাছে। তবুও সম্পর্ক বেশ ভালোই ছিল দুজনের মধ্যে। সপ্তাহের পাঁচটা দিন সংসারের কাজকর্ম নিয়ে পড়ে থাকত সরোজিনী। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত শনিবারের জন্যে। কিন্তু মাত্র দুদিন স্বামীর সান্নিধ্য পেয়ে মন ভরত না তার। সে চাইত নিবারণ সবসময় তার কাছে কাছে থাকুক। কিন্তু তা তো হবার জো নেই। মাকে বাড়িতে একা রেখে বৌকে নিয়ে শহরে থাকা শুধু অন্যায় নয় , অপরাধ বলে মনে করত নিবারণ। আবার মা ও বৌ দুজনকে নিয়েই শহরে থাকতে গেলে একটা রুমে হবে না ।কম করে দুটো রুম ভাড়া নিতে হবে। অত টাকা ভাড়া মেটাবার সামর্থ্যও যে তার নেই।
বছর খানেক যাবার পর স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে যেন একটু চিড় ধরতে শুরু করল। সম্পর্কটা যাতে মসৃণ থাকে তার জন্যে শহরে একটা বাসা নেবার চাপ দিতে শুরু করল নিবারণকে। কিন্তু নিবারণের মুখে সেই একই কথা। আগে প্রোমোশনটা হোক । তাহলে বেতন বাড়বে। তখন মা এবং সরোকে নিয়ে শহরে শিফট করতে পারবে সে। কিন্তু প্রমোশনের জন্যে আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে তাকে?না, এই জীবন আর মোটেই ভালো লাগছে না তার। তবুও বেশ কয়েকটা মাস এইভাবেই কেটে গেলো সরোজিনীর। সব জেনেশুনেই তো নিবারণকে বিয়ে করেছে সে। সব কিছু মানিয়ে গুছিয়ে তো তাকে চলতেই হবে। চলার চেষ্টাও করে সরো। কিন্তু মাঝে মধ্যে মনটাকে বশে রাখতে পারে না সে। বিদ্রোহী হয়ে উঠে তার মন।
একদিন বাড়িতে বেড়াতে আসে নিবারণেরই এক মাসতুতো ভাই সুজয়। শাশুড়ি মা-ই সুজয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় সরোজিনীর। প্রথম পরিচয়েই তাকে বৌদি বলে সম্বোধন করে সুজয়। সরোজিনীরও সুজয়কে দেখে ভালো লাগে তার মিস্টি মধুর ব্যবহার দেখে। নিজের হাতে রান্না করে সুজয়কে খাওয়ায় সরো। বাড়ি যাবার সময় আবারও আসার জন্যে আমন্ত্রণ জানায় তাকে।
নিবারণদের বাড়িতে এরপর ঘন ঘন যাতায়াত শুরু হয় সুজয়ের। প্রতি সপ্তাহেই আসতে শুরু করে সে। সরোর সঙ্গে হাসি ঠাট্টা গল্প গুজব করে। কোনো কোনোদিন রাত্রেও থেকে যায় সে। অবশ্য এর পিছনে তার শাশুড়ি মায়ের প্রচ্ছন্ন সম্মতিও যে আছে তা বুঝতে পারে সরোজিনী। আজকাল আর বাড়িতে এতটা বোরিং লাগে না তার। সুজয়কে পেয়ে যেন জীবনের অন্য একটা মানে খুঁজে পেয়েছে সে। এইভাবে একটু একটু করে সুজয়ের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে সরোজিনী। আজ যেন অধরাকে ধরতে পারার স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে সে। কিন্তু নিজেরই অজান্তে যে নিজেরই কবর খুঁড়ে চলেছে সে হুঁস তখন ছিল না তার। পরকীয়া প্রেম ভুলিয়ে দিয়েছে তার সব নৈতিকতা --- সব বিবেকবোধ।
কোনো ঘটনাই বেশিদিন গোপন থাকে না। গোপন থাকেনি সুজয় সরোজিনীর অবৈধ সম্পর্কও। প্রথমে জানতে পারে পাড়াপ্রতিবেশিরা। এরপর কানাকানি হতে হতে খবরটা রটে যায় গোটা গ্রামে। কিছু অত্যুৎসাহী লোকের আগ্রহে বেশ মুখোরোচক হয়ে খবরটা ছড়িয়ে পড়ে নিবারণের বন্ধু মহলে। বন্ধুদের কাছ থেকেই নিবারণ জানতে পারে খবরটা। শুরু হয় সংসারে অশান্তি। কিন্তু এই অশান্তির দায়টা একা সরোজিনীর নয় সে কথা মানে সে। তখনও সরোজিনীর প্রতি তার বিশ্বাস ও ভালোবাসা একেবারে উবে যায়নি। সুজয়ের সঙ্গে সরোজিনীর সম্পর্ক একটা accident বলেই ধরে নিয়েছিল সে । ভেবেছিল সে যা শুনেছে লোকে তা হয়তো একটু বাড়িয়েই বলেছে। আসলে সরোজিনী ততটা খারাপ মেয়ে নয়। সে এখনও তাকে আগের মতোই ভালোবাসে। কোনো দুর্বল মুহূর্তে হয়ত পদস্খলন হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়। এখান থেকে শহরে চলে গেলে সরো আবার আগের মতোই স্বামী অনুগতা হয়ে থাকবে। একটা ভুলের জন্যে তাকে ক্ষমা করা যেতেই পারে। সুযোগ দেওয়া যেতে পারে তাকে শুধরে নেওয়ার। তাই যেন কিছুই হয়নি এইরকম ভাব করে সরোজিনী ও মাকে শহরে গিয়ে থাকার প্রস্তাব দেয় নিবারণ। কিন্তু বেঁকে বসে সরোজিনী। যুক্তি দেখায় শশুর শাশুড়ির ভিটে ছেড়ে শহরে গিয়ে সুখ পাবে না সে। এটা তার আর পাঁচটা গ্রাম্য মেয়ের মতো উপরের বিনয়। সততার মুখোশ পরে অন্তরের অনৈতিক কাজটাকে সমর্থন করার অপপ্রয়াস মাত্র। সরোজিনীর দেহমন এখন সুজয়ময়। এই স্বর্গ সুখ ছেড়ে কেন যাবে সে? কিসের জন্যে যাবে? যখন যাবার কথা বলেছিল তখন নিয়ে যায়নি কেন? তাহলে তো তার জীবনে এমন বিপত্তি ঘটত না।
ইতিমধ্যে সরোজিনীর গর্ভে সন্তান আসে। গর্ব করে নিবারণের কাছে সে কথাটা জানায় সরোজিনী। কিন্তু ধমক খেতে হয় নিবারণের কাছে। সে স্পস্টই জানিয়ে দেয় যে সন্তান তার গর্ভে এসেছে সে সন্তান তার নয় --- সুজয়ের । শুনে কালনাগিনীর মতো ফোঁস করে উঠে সরোজিনী। নিবারণও দমার পাত্র নয়। এই মানসিক যন্ত্রণা থেকে সে অব্যাহতি পেতে চায়। অব্যাহতি পেতে চায় সরোজিনীর কাছ থেকেও। একদিন অশান্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে সরোজিনীকে একরকম ঘাড় ধরে বের করে দেয় নিবারণ। মনে মনে এইটাই চাইছিল সে। সুজয় তাকে অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছে। স্বপ্ন দেখিয়েছে তাকে নতুন করে বাঁচতে শেখানোর। সেই স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে সরোজিনী। নিবারণের কাছ থেকে মুক্তি পাবার একটা পথ খুঁজছিল সরোজিনী। নিবারণ নিজেই সেই পথ করে দিয়েছে। তাই কোনো প্রতিবাদ না করেই সোজা সুজয়ের কাছে গিয়ে হাজির হয় সরোজিনী। সুজয় এতটা আশা করেনি। সরোজিনী যে নিবারণকে ছেড়ে সত্যিই তার কাছে চলে আসবে এতটা ভাবেনি সুজয়। তাই সে পড়ল মহা ফাঁপড়ে। সাপের ছুঁচো গেলার মতো অবস্থা। ছাড়তেও পারে না আবার গিলতেও পারে না। কিন্তু এখন তো এতো ভাবার সময় নয়। হয় সরোজিনীকে ঘরে তুলতে হবে নয় অন্য পথে যেতে হবে। একটা বিবাহিতা মেয়েকে ঘরে তোলা! তাও আবার সন্তানসম্ভবা মেয়ে! কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সরোজিনীকে বসতে বলে একটা বন্ধুর সঙ্গে পরামর্শ করতে যায় সে। ফিরে আসে কিছুক্ষণ পরে। সরোজিনীকে বারবার অনুরোধ করে তার স্বামীর কাছে ফিরে যাবার জন্যে। কিন্তু রাজী হয় না সরোজিনী। ফিরে যাবে বলে তো সে আসেনি। সে এসেছে পাকাপাকিভাবে সুজয়কে নিজের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নিতে। কিন্তু এটা যে কল্পনাবিলাস ছাড়া কিছু নয় একটু পরেই টের পায় সে। টের পায় সুজয়ের রুঢ় প্রত্যাখান শুনে।
নিবারণের কাছে ফিরে যাওয়ার পথ বন্ধ। আশ্রয় পেল না সুজয়ের কাছেও। সংসারের সব পুরুষই কি একই ধাতে গড়া? মেয়েরা কি তাদের ভোগের সামগ্রী মাত্র? পুরুষ জাতটার প্রতি ঘৃণা ও আক্রোশে গা রি রি করে উঠে তার। দুই পুরুষ মিলে তার যৌবনটাকে লুটে পুটে খেয়েছে। পুরুষ জাতটাই যেন তার জাতশত্রু। এবার যাবে কোথায় সে? কার কাছে আশ্রয় পাবে? যাবার এখন তো একটাই মাত্র জায়গা আছে। সে তার বাবা। বাবা হলেও সেও তো একটা পুরুষ। এতক্ষণে সে যেন বুঝতে পারে পুরুষই হচ্ছে মেয়েদের একটা আশ্রয়স্থল। জীবন কাটাতে গেলে এমন একটা আশ্রয়ের দরকার আছে। হয় স্বামী , নয় ছেলে, নয় অন্য কেউ।
বাবার বাড়িতে কিছুদিন থাকার পর এক সন্তানের জন্ম দেয় সরোজিনী। সুন্দর ফুটফুটে চেহারা। সরোজিনীর বাবা তার নাম দেয় মতি। ভালো নামের প্রতি সরোজিনীরও আর কোনো আগ্রহ ছিল না। জন্মটাই যার রহস্যে ভরা তাকে নিয়ে গৌরবের কিছু আছে বলে মনে করে না সরোজিনী। তবু মা তো। বাবা ত্যাগ করলেও মা তো তাকে ত্যাগ করতে পারে না।
এরপর আরো এক বিপর্যয় নেমে আসে সরজিনীর জীবনে। হঠাৎঅসুস্থ হয়ে মারা যায় তার বাবা। এবার সত্যিই অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে সরোজিনী। অতি কষ্টে মতিকে নিয়ে একাকী জীবনটাকে টেনে নিয়ে চলে সে। শুরু করে পরের বাড়ি বাড়ি কাজ করা। তখনও যৌবনে ভাটা পড়েনি তার। অনেক শকুনের দল সু্যোগ খোঁজে তার শরীরটাকে খুবলে খুবলে খাবার। বহুকষ্টে নিজেকে আড়াল করে রাখতে চায় সে। কিন্তু বেশিদিন পারে না।
সরোজিনীর উপর নজর পড়ে গ্রামেরই এক উঁচু জাতের ছেলে সাধনের। তাকে ভালোবাসার স্বপ্ন দেখায় সে। বিয়ে করার প্রস্তাবও দেয় একদিন। কিন্তু ততদিনে পুরুষের স্বভাব চেনা হয়ে গেছে তার। সরোজিনী ভালোভাবেই বুঝেছে সুজয়ের মতো সাধনও তার শরীরটাকেই চায়--- মনটাকে নয়। তাই পাত্তা দেয় না সাধনকে। ইগোতে লাগে সাধনের। সরোজিনীকে উপযুক্ত শিক্ষা দেবার জন্যে সুযোগের অপেক্ষায় থাকে সে।
সুযোগ পেয়েও যায় সাধন। দিনটা ছিল দুর্যোগপূর্ণ। মাঝে মধ্যে দমকা বাতাস আর ঝিরঝিরে বৃষ্টি। দুদিন আগে থেকেই শুরু হয়েছে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া। সকাল সকাল খেয়েদেয়ে যে যার ঘরে শুয়ে পড়েছে। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঝড়ের দাপটে ইলেকট্রিকের খুঁটি উপড়ে পড়েছে। ছিঁড়ে গেছে তারও। দুদিন থেকে গ্রামে কারেন্ট নেই। ঠিক এই দিনটার জন্যেই অপেক্ষা করছিল সাধন। পাঁচিল টপকে সরোজিনীর ঘরে ঢুকল সে। কুপ্রস্তাব দিল সরোজিনীকে। রাজী হলো না সে। বারবার অনুরোধ করল ফিরে যেতে। কিন্তু কোনো কথায় কর্ণপাত করল না সাধন। পাড়া প্রতিবেশিদের চিৎকার করে ডাকতে লাগল সরোজিনী। কিন্তু তার ডাক কারও কানে পৌঁছালো না। হিংস্র বাঘের মতো সরোজিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। পাশে ছেলেটা ঘুমোচ্ছিল। কথা কাটাকাটিতে জেগে উঠল ছোট্ট মতি। কাঁদতে শুরু করল সে। সরোজিনী বুকে তুলে নেবার চেষ্টা করল তাকে। কিন্তু এক ধাক্কায় ছেলেটাকে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সরোজিনীর দিকে এগিয়ে গেল সাধন। উপায়ান্তর না দেখে বিছানার নীচে রাখা ছুরিটা শক্ত করে ধরল সরোজিনী। আমূল বসিয়ে দিল সাধনের বুকে। রক্তে রাঙ্গা হয়ে উঠল ঘরের মেঝেটা।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সেই ঝড়বৃষ্টির রাতেই মতিকে বুকে নিয়ে অজানার পথে বেরিয়ে পড়ল সরোজিনী। উঠলো গিয়ে অনেক দূরের এক দূর সম্পর্কিত কাকার বাড়িতে। আশ্রয়হীনা বিধবা বলে সেই কাকা আশ্রয় দিল তাকে। কিন্তু সেখানেও গা ঢাকা দিয়ে থাকতে পারল না সরোজিনী। পুলিশ একদিন খুঁজে বের করল তাকে। বিচারে দশ বছরের কারাদন্ড হলো সরোজিনীর।
কারাভোগ শেষে একদিন সেখানে ফিরে এলো সরোজিনী। দেখল মতি নেই। তার সম্পর্কিত কাকা তাকে অনাথ আশ্রমে দিয়ে দিয়েছে। সেখানেও আর স্থান হলো না সরোজিনীর। গ্রামের বাইরে একটা কুঁড়ে টাঙ্গিয়ে থাকে সে। অনাথ আশ্রম থেকে মতিকে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল সরোজিনী। কিন্তু আসেনি সে। খুনী মায়ের সান্নিধ্য নাকি পছন্দ নয় তার।