শুক্লা কর
শুক্লা কর
দূরত্ব
ছেলেটাকে নিয়ে চিন্তার শেষ নেই সায়নীর। এমনি সবই ভালো। তবে পড়াশোনায় বড্ড অমনযোগী। সায়নী এত চেষ্টা করে, তবু কিছুতেই ছেলেটা প্রতি বিষয়ে চল্লিশ-- পঁয়তাল্লিশের বেশি নম্বর পাবে না। অথচ পড়াশোনার ব্যাপারে হিমাদ্রির থেকে অর্কর দিকে কম খেয়াল তো রাখে না সে। হোমওয়ার্ক থেকে শুরু করে পরীক্ষার পড়া---সবই দেখে সায়নী। তবু ছেলেটা কিছুতেই ফিফটি পার্সেন্ট টপকাতে পারে না।
অথচ হিমাদ্রি! অর্কর থেকে দু বছরের ছোটো। সবে ক্লাস সেভেন। কিন্তু এই বয়সেই এত সিরিয়াস ভাবা যায় না। সায়নীকে একবারও বলতে হয় না, পড়তে বস। স্কুল থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে টিফিন করেই হোমওয়ার্ক নিয়ে বসে পড়বে। অর্ক ওসবের ধার ধারে না। সে ততক্ষণে ছবি আঁকা নিয়ে ব্যস্ত। সায়নী মাঝে মাঝে রেগে গিয়ে বলে, তোর রঙ তুলি সব ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসব। অর্ক কোনো কথা না বলে এক আশ্চর্য দৃষ্টিতে সায়নীর দিকে তাকিয়ে থাকে তখন।
দেবাংশু এসব ব্যাপারে একেবারে মাথা ঘামায় না। তার আর সময়ই বা কোথায়? ব্যাঙ্কের ম্যানেজার। প্রচন্ড কাজের চাপ। সায়নী তবুও মাঝে মধ্যে অভিযোগ করে অর্ককে নিয়ে। দেবাংশু বোঝায়। বলে, ও যেভাবে চাইছে সেভাবেই ওকে থাকতে দাও না। সবাই যে ফার্স্ট সেকেন্ড হবে এমনটাই বা ভাবছ কেন! ও ছবি আঁকতে ভালোবাসে। চমৎকার ছবি আঁকেও তো।
সত্যিই চমৎকার অর্কর ছবি আঁকার হাত। দেওয়াল জুড়ে একটা শো-কেসে শুধু বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় পাওয়া পুরস্কার ও মেডেল।
সায়নী উত্তেজিত গলায় বলল, শুধু আঁকলেই চলবে? ওতে কোনো ভবিষ্যৎ আছে? পড়াশোনাটাও তো ঠিকঠাক করতে হবে। যা কঠিন দিনকাল পড়েছে!
দেবাংশু বলল, এত অস্থির হোয়ো না তো। পড়াশোনা ঠিক হবে।
নাহ্, অনেক চেষ্টা করেও সায়নী অর্কর পড়াশোনায় বিশেষ উন্নতি করতে পারেনি। মাধ্যমিকে ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করে আর্টস নিয়েই ভর্তি হল। সায়নীর ইচ্ছে ছিল সায়েন্স নিয়ে পড়ুক। কিন্তু অর্কর ইচ্ছে ছিল না এবং ওই নম্বরে সায়েন্স পাওয়া যাবে না। সুতরাং আর্টস ছাড়া উপায় নেই।
ইদানিং বড় চুপচাপ হয়ে গেছে অর্ক। সায়নী কথা বললে হ্যাঁ না করে উত্তর দেয়। নিজেকে যেন ক্রমশঃ গুটিয়ে নিচ্ছে ছেলেটা। যেটুকু সময় বাড়িতে থাকে আঁকার ঘরে ঢুকে ছবি আঁকে।
হিমাদ্রি এ বছর মাধ্যমিক দিয়েছে। দারুন রেজাল্ট।সায়নীর গর্বের যেন অন্ত নেই। আত্মীয়-স্বজনদের সকলকে ফোন করে জানাল। অভিনন্দনের বন্যা বইতে লাগল। সায়নী হিমাদ্রিকে এমনিতেই বেশি ভালোবাসে। রেজাল্ট ভালো করায় ইদানিং যেন সেই ভালোবাসা আরও বেড়ে গেছে। সায়েন্স নিয়ে ভর্তি হল হিমাদ্রি। রাতে খাওয়ার টেবিলে বসে সায়নী কথায় কথায় অর্ককে বলল, তুই একটু ভালো করে পড়াশোনা করলে তুইও সায়েন্স নিয়ে পড়তে পারতিস।
দেবাংশু প্রতিবাদ করে বলল, সবাইকে সায়েন্স নিয়ে পড়তে হবে এমন কোথায় লেখা আছে সায়নী?
সায়নী বলল, আর্টস নিয়ে পড়ে কী লাভ হবে বলো তো? ওই গ্র্যাজুয়েশনটাই হবে শুধু।
অর্ক মাথা নিচু করে খাবারগুলো নাড়াচাড়া করতে লাগল।দেবাংশু বলল, আমার অর্ক মস্ত বড় আর্টিস্ট হবে দেখো।
সায়নী ঠোঁট উল্টালো। দেবাংশু লক্ষ্য করল, অর্কর চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়ছে খাবারের থালায়। চোখ ভিজে এল দেবাংশুর। কেন যে সায়নী এত অপ্রস্তুতে ফেলে ছেলেটাকে!
কোনমতে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করল অর্ক। আজকাল ছবি আঁকা নিয়েই ব্যস্ত থাকে। খাওয়ায় কথাও মনে থাকে না। মাঝে মাঝে মাঝরাতে উঠে দেবাংশু অর্কর ঘরে গিয়ে দেখে তখনও আঁকছে। কোনোদিন আবার অন্ধকার ছাদে গিয়ে বসে থাকে।দেবাংশু আজকাল আর বুঝে উঠতে পারে না ছেলেটাকে। সায়নী তো কবেই যেন একটা বিরাট দূরত্ব তৈরি করে ফেলেছে অর্কর সাথে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে দেবাংশু।
হিমাদ্রি মেডিক্যালে চান্স পেয়েছে। সায়নী যেন একটা অন্য সায়নী। ছেলেকে নিয়ে ভীষণ গর্বিত সে।অর্কর দিকে আর লক্ষ্যই নেই। ছোট ছেলেই যেন ধ্যান-জ্ঞান।
পেরিয়ে গেছে বেশ কয়েকটা বছর। হিমাদ্রি মেডিক্যাল পড়া শেষ করে চলে গেল সুইজারল্যান্ড। ওখানেই একটি মেয়েকে বিয়ে করেছে। সেও ডাক্তার। ওখানেই সেটল করেছে ওরা। আগে মাঝে মাঝে বাড়ি আসত। এখন নাকি আসার সময় পায় না।
দেবাংশু ফোন করলেই হিমাদ্রিকে বলে, ইন্ডিয়ায় চলে আয়। প্রতিবারই হিমাদ্রি বলে, এখানেই ভালো আছি বাবা। ইন্ডিয়ায় কিচ্ছু নেই।
সায়নীও আগে ফোন করে ফিরে আসার কথা বলত হিমাদ্রিকে। হিমাদ্রির সেই একই উত্তর। আজকাল আর তাই কিছু বলে না সায়নী। ফোন এলে সৌজন্যমূলক বাক্য বিনিময় ছাড়া তেমন কোনো কথাই হয় না আজকাল। সায়নীই এড়িয়ে যায়। যে ছেলেকে এত আগলে বড় করেছে সেই ছেলে যে এমন করে দূরে সরে যাবে সেটা স্বপ্নেও ভাবেনি সায়নী। এক ভীষণ অভিমানে বুক ভারী হয়ে আসে মাঝে মাঝে।
অর্ক এখন নামী চিত্রশিল্পীদের একজন। বিভিন্ন রাজ্যে তার আঁকা ছবির প্রদর্শনী হয়েছে। নানান আন্তর্জাতিক মানের ম্যাগাজিনে তার আঁকা নিয়ে আলোচনা হয় নিয়মিত। বেশ কিছু ছবি পুরস্কৃত হয়েছে।
এই শহরের নামী আর্ট গ্যালারি "সৃষ্টি"তে অর্কর ছবির প্রদর্শনী চলছে। আজ সায়নী আর দেবাংশু এসেছে। কত নামী দামী ব্যক্তিত্বরা অর্কর ছবি প্রদর্শনী দেখতে এসেছে! সায়নী যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
দেবাংশু বলল, জানো, এই প্রদর্শনীতে একটা ছবি পুরস্কৃত হয়েছে। সেটার দাম উঠেছে কয়েক লক্ষ টাকা।
কথাগুলো বলতে বলতে দেবাংশুর মুখ চকচকে হয়ে উঠছিল।সায়নী অবাক চোখে দেবাংশুর দিকে তাকালো। দেবাংশু বলল, ওই কর্নারে আছে ছবিটা।চলো দেখে আসি।
ছবিটার সামনে বেশ ভিড়। একটু সময় অপেক্ষা করতে হল। ফাঁকা হতেই পুরস্কৃত ছবির দিকে এগিয়ে গেল সায়নী ও দেবাংশু।
ছবিতে চোখ পড়তেই চমকে উঠল সায়নী। কাকে এঁকেছে অর্ক! এ তো সায়নীর ছবি। একটা টুলের উপর এলোচুলে সে বসে আছে।আর তার কোলে মাথা রেখে মেঝেতে বসে আছে অর্ক। ছবিটার নাম--মাতৃস্নেহ।
পড়াশোনা ভালো করত বলে বরাবর হিমাদ্রিকেই বেশি ভালোবাসত সায়নী। এমনভাবে কখনো অর্ককে কাছে টেনে নেয়নি। ছবিটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল সায়নীর।চোখ দুটো একটু ভিজেও এল বোধহয়।
আজীবন ছেলেটাকে শুধু তাচ্ছিল্যই করেছে সে।আজ ভীষণ ইচ্ছে করছে ছেলেটাকে একবার বুকে জড়িয়ে ধরতে। এত মানুষের ভিড়ে চারিদিকে অর্ককে খুঁজতে লাগল সায়নী। খুঁজে পেল না। ভিড়ের মাঝে কোথায় যেন সে হারিয়ে গেছে!