প্রীতম সরকার
প্রীতম সরকার
দাদাঠাকুর এবং বোতলপুরাণের গল্প
কোনও কোনও মানুষ থাকেন যাঁরা বেঁচে থাকার সময়ই কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন। তাঁদের জীবন নিয়ে ছড়িয়ে যায় নানারকম গল্পকথা। এরমধ্যে কিছুটা হয়তো সত্যি, আবার কিছুটা হয়তো অতিরঞ্জিত। বাগ্লায় যেমন ছিলেন দাদাঠাকুর। যাঁর আসল নাম শরৎচন্দ্র পণ্ডিা। তিনি জন্মেছিলেন ১৮৮১ সালে বীরভূম জেলায়। মৃত্যু হয়েছিল ১৯৬৮ সালে। তবে মানুষটি আর সাধারণ পাঁচজনের মতো ছিলেন না। তাঁর রসবোধ ছিল একদমই আলাদা। ছিলেন সহৃদয়, পরোপকারী, খুব সরল মানুষ। অন্যদিকে ছিলেন সামাজিক স্খলনের প্রতিবাদে ক্ষুরধার এবং সরস ব্যঙ্গের ভাষায় সুনিপুণ। দাদাঠাকুর বিশেষণেই তাঁর পরিচয়।
দাদাঠাকুরের বাবা হরিলাল পণ্ডিতের আদি বাড়ি ছিল বীরভূমের ধরমপুর গ্রামে। পরে চলে আসেন মুর্শিদাবাদের দহরপুরে। শৈশবে অনাথ শরৎচন্দ্র জঙ্গিপুরে কাকা রসিকলালের কাছে মানুষ হয়েছিলেন। মেধা ও স্মরণশক্তি ছিল প্রখর। এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বর্ধমান রাজ কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে কলেজের পড়া চালাতে পারেননি। ঠিক করলেন গ্রামে ছাপাখানা বসিয়ে এবং পত্রিকা সম্পাদনা করে সংসারের খরচ চালাবেন। ছাপাখানার সব কাজ নিজেই করতেন - কম্পোজ করা, প্রুফ দেখা, ছেপে কপি বের করা এবং নিজের হাতে পথে পথে ঘুরে পত্রিকা বিক্রি করা। ‘জঙ্গীপুর সংবাদ’ নামের সাপ্তাহিক পত্রিকায় সবরকম অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতেন তিনি। তাঁর সম্পাদিত আর - একটি পত্রিকা ছিল ‘বিদূষক’। যেখানে রঙ্গব্যঙ্গের মাধ্যমে সত্যি ঘটনাকে তুলে ধরাই তাঁর লক্ষ্য ছিল। বোতলের আকারে এক-একটি সঙ্কলন মাঝে মাঝে প্রকাশ করতেন - নাম ছিল ‘বোতলপুরাণ’। সংসারে স্বচ্ছলতা ছিল না কিন্তু কখনও কারও কাছে মাথা নীচু করেননি। শাসকশক্তি থেকে প্রভাবশালী বিত্তবান - সমালোচনার তীর ছুঁড়ে দিতেন সকলের দিকেই। অতিসাধারণ ধুতি-চাদর পরিহিত মানুষটি তখনকার রাজ্যপাল থেকে শুরু করে গ্রামের সাধারন মানুষদের কাছেও ছিলেন সমান জনপ্রিয়।
তাঁর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়বার একটি কারণ অবশ্য ছিল কলকাতা বেতার-কেন্দ্রের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘকালের সম্পর্ক। বেতারকেন্দ্রের নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, রাইচাঁদ বড়াল, কাজী নজরুল ইসলাম, পঙ্কজকুমার মল্লিক, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠজন। প্রমথনাথ বিশী তাঁকে বলেছিলেন ‘এ যুগের শ্রেষ্ঠ হিউমারিস্ট’। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে সমকালের সাহিত্যিক এবং সঙ্গীতশিল্পীদের সঙ্গে তাঁর ছিল সমানে-সমানে বন্ধুত্ব। ভাষার উপর ছিল অসাধারণ দখল। যে কোনও আড্ডায় ছিলেন মধ্যমণি। সে গল্প সবারই জানা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘দাদাঠাকুর’-কে দেখে বললেন - এই যে ‘বিদূষক শরৎচন্দ্র’। দাদাঠাকুর-এর উত্তর ছিল - এই তো দেখছি ‘চরিত্রহীন শরৎচন্দ্র’।
এখানে দাদাঠাকুরের কাছে রাজনৈতিক কারণে এক সময় আশ্রয় নিতে এসেছিলেন পরবর্তী সময়ের বিখ্যাত প্রাবন্ধিক, সম্পাদক নলিনীকান্ত সরকার। আশ্রয় তো তিনি পেলেনই, দাদাঠাকুরের সঙ্গে তাঁর গড়ে উঠল দাদা-ভাইয়ের সম্পর্ক। দাদাঠাকুর তাঁকে ডাকতেন নলে বলে। নলিনীকান্তের সঙ্গে দাদাঠাকুরের স্নেহের সম্পর্কে কখনও ছেদ পড়েনি। ‘বোতলপুরাণ’ আর ‘বিদূষক’ নিয়ে ফি সপ্তাহে দাদাঠাকুর কলকাতায় আসতেন। বিক্রি করতেন রাস্তায় দাঁড়িয়ে। শরৎ পণ্ডিত ওরফে দাদাঠাকুরকে নিয়ে নানা কাহিনি আজও শুনতে পাওয়া যায়৷
কলকাতাতেই পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াতেন তিনি৷ খালি গা, খেটো ধুতি, কাঁধে বোঁচকা৷ আর তাতে ‘বিদূষক’, ‘বোতল পুরাণ’ নামের পত্রিকা৷ দাদাঠাকুর নামেই তিনি বাঙালির কাছে পরিচিত৷
বোতলের মতো দেখতে একটা বই। যে সে বোতল নয়, খাঁটি মদের বোতল। বোতলাকৃতি বইয়ের বাইরেটা কালো মোটা কাগজের আর ভিতরে লাল কাগজের পাতায় পাতায় মাতালদের উদ্দেশ্যে ছাপানো কবিতা। বইয়ের নামটিও ছিল খাসা - ‘বোতলপুরাণ’। অত্যন্ত প্রতিভাধর রসিক বাঙালি ছাড়া এমন রোমহর্ষক রচনা করে কার সাধ্য! নিজের প্রেসতই ছিল জঙ্গিপুরে। নাম দিয়েছিলেন ‘পণ্ডিত প্রেস’।
কলকাতার রাস্তায় গালি গায়ে, খালি পায়ে দাদাঠাকুর গাইতে গাইতে ফেরি করতেন তাঁর বই। চৌরঙ্গি, বড়োবাজার, কলেজ স্ট্রিট - জায়গার সঙ্গে সঙ্গে গানও বদলে যেত। এক এক জায়গার লোকের রুচি একেক রকম। লোকরুচি, মনস্তত্ত্ব দারুণ বুঝতেন বটে শরৎচন্দ্র পণ্ডিত। যেমন, বড়োবাজার অঞ্চলে অবাঙালিদের বাস বেশি। দাদাঠাকুর সেখানে গাইতে গাইতে যেতেন -'কালা এইসা বোতলমে লাল রঙকে মাল/ দো আনা পৈসা দেকে পিয়ালামে ঢাল/ ইস্মে নেহি দারু/ খালি হ্যায় মিঠি ঝাড়ু/ পিকে শায়েস্তা হোগা শরাবি মাতাল।'
মদের বোতলের মতো বই বেচতে দেখে একবার তাঁকে পাকড়াও করল ব্রিটিশ পুলিশ। দাদাঠাকুর সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজিতে গান বানিয়ে শোনালেন লালমুখো ইংরেজ পুলিশকে। সে তো তাজ্জব। খালি গা, খালি পা নেটিভ হকারটা কিনা ইংরেজিতে এমন গান বানায়! পুলিশ দাদাঠাকুরকে গ্রেপ্তার করলো না। বোতলপুরাণের ফেরিও চলতে থাকল।
বিশ শতকে দাদাঠকুরের মতো রসিক আর একটিও খুঁজে পাওয়া এখনকার দিনে প্রায় অসম্ভব। জঙ্গিপুর থেকে হাওড়া পর্যন্ত সব স্টেশনের নাম মনে রাখার জন্য তৈরি করেছিলেন একটি নামাবলি-গান। তাতে আবার দু'ধরনের সুর-প্রভাতী আর গজল। ‘...আজিমগঞ্জ সিটি করি দরশন/ মুনিগ্রাম, গণকর পেরিয়ে/ জঙ্গিপুর আমার ঘর।’ একবার ট্রেনে আসতে আসতে উদাত্ত কণ্ঠে এই গান গাইছেন দাদাঠাকুর, এক টিকিট-চেকার তাঁকে বললেন অন্য স্টেশনগুলোই বা বাদ থাকে কেন? তাঁর মুখের কথা মুখেই রইল। দাদাঠাকুর চটজলদি গান ধরলেন -'সজনিপাড়া, নিমতিতা, ধুলিয়ান গ্যাঞ্জেস/ তিলডাঙা, বারহারোয়াতে শেষ। এ লাইনে দফা রফা/ তার পরে লুপ লাইন ধর।’
তবে, দাদাঠাকুরের সবচেয়ে বিখ্যাত গান ‘কলকাতার ভুল’। এই গানকে বিখ্যাত করে তুলেছিলেন নলিনীকান্ত সরকার। তিরিশের দশকের শেষদিকে একবার ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে দিলীপকুমার রায়ের সংবর্ধনা সভায় নলিনীকান্ত গাইলেন এই গান - মরি হায় রে,/ কলকাতা কেবল ভুলে ভরা/... আমি মুর্গিহাটায় চুপ করে যাই/ কিনতে রামপাখি,/ দেখি সারি সারি স্টেশনারি/ আসল জিনিস ফাঁকি/...নাইকো হাতি নাইকো বাগান/ হাতিবাগান বলে,/ বাদুড়বাগানেতে দেখি/ বাদুড় নাহি ঝোলে।’
সেদিন দর্শকাসনে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথ নাকি খুব প্রশংসা করেছিলেন এই গানের। একবার দিলীপকুমার রায়ের আমন্ত্রণে থিয়েটার রোডে তাঁর মামাবাড়ি গিয়েছেন দাদাঠাকুর। সেখানে আসরেও গাইলেন ‘কলকাতার ভুল’। গান শুনে শ্রোতাদের একজন বললেন, এই গানে থিয়েটার রোডের নাম নেই তো। দাদাঠাকুর সঙ্গে সঙ্গে গেয়ে উঠলেন - ‘থিয়েটার রোডে যে দেখি/ থিয়েটার তো নাই হায়/ তবে থিয়েটারের সাধ মেটালো দিলীপকুমার রায়।’ সাধে কি তাঁকে 'বাংলার শেষ কবিয়াল' বলে ডাকত লোকজন।
কিছু কিছু গান দীর্ঘদিন প্রাসঙ্গিক থেকে যায় স্রষ্টার গুণে। আর, সেই স্রষ্টা যদি দাদাঠাকুর হন তো বলাই বাহুল্য! ক্রমশ রসিকতা ভুলে হুঁকোমুখো হ্যাংলায় পরিণত হতে থাকা বাঙালিদের দিকে এমন সব গান কিংবা বোতলপুরাণ এগিয়ে দেওয়ার জন্য দাদাঠাকুরদের যে কী প্রয়োজন ছিল এখন!
তবু সব কিছুর পরেও আমার একটি ব্যক্তিগত প্রশ্ন আছে। তিনি চটি বা জুতো পায়ে দিতেন না। হওড়া স্টেশন থেকে খালি পাএ হেঁটে আসতেন তখনকার বেতার-কেন্দ্র গর্স্টিন প্লেসে। দাদাঠাকুর ছিলেন আপাদমস্তক বাঙালি। তাঁর পরিবারের অভাব ছিল, অনটন ছিল। কিন্তু কখনও কারও কাছ থেকে সামান্য দান গ্রহণ করেননি। এমনকি শিক্ষিত হয়েও চাকরির প্রতি তার কোন টান ছিল না। স্বাধীনভাবে কিছু করতে হবে এটাই ছিল দাদাঠাকুরের মানসিকতা। সকলকেই তিনি এই উপদেশ দিতেন। ইংরেজ সরকারের অধীনে চাকরি করাকে তিনি ‘দাসত্ব’ বলে মনে করতেন।
সেসময় তাঁর রচিত ‘বোতল পুরাণ’ কলকাতার রাস্তায় ফেরি করে বিক্রি করতেন তিনি। রাস্তায় গাইতেন, ‘আমার বোতল নিবি কে রে?/ এই বোতলে নেশাখোরের নেশা যাবে ছেড়ে।’ হিন্দিতে গাইতেন, ‘ইস মে নেহি দারু/ খালি হ্যায় মিঠি ঝাড়ু/ পিকে শায়েস্তা হোগা শরাবী মাতাল।’ সাধারণ মানুষের টাকার প্রতি আসক্ত থাকাটা নিয়ে তীব্র ব্যঙ্গ করেছেন তাঁর ‘টাকার ঊনপঞ্চাশ নাম’ ছড়াতে। সেখানে লিখেছেন, ‘জয় টাকা জয় অর্থ রাজমূর্তি ধর/ রৌপ্যখণ্ড কর কৃপা সুখের সাগর।’ কবিতার শেষে লিখেছেন –‘তুমি জ্ঞান, তুমি ধ্যান তুমি সারাৎসার/ তুমি বিনা দেখি প্রভু সব অন্ধকার।’ পরে লেকাটি ‘শতনামে’ বর্ধিত করেছিলেন। কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনামের অনুকরণে লেখা এই কশাঘাত জর্জরিত কবিতাটিতে বাঙালির অর্থলোলুপতাকে নির্মম ভাবে আঘাত করেছেন তিনি। অন্য গানে বলেছেন, ‘দূরিত বিনাশিনী তঙ্কে/ রাজরাজেশ্বর মূর্তি বিভূষিতা/ রজতশুভ্র শুভ অঙ্কে।’ গানটি ‘পতিতপাবনী গঙ্গে’ নামের বিখ্যাত গানের সুরে গাওয়া হত।