সুজয় সাহা
সুজয় সাহা
জোকা স্বামীনারায়ণ মন্দির
আমার অনেকদিন ধরে কোথাও বেড়াতে যাবার ইচ্ছা ছিল। এর আগেও বহু দূরদূরান্ত জায়গায় বহুবার বেড়ানো হয়ে গেছে। কিন্তু একই স্থানে
বারবার করে বেড়াতে ভালো লাগে না। তাই এবার একটা নতুন স্থানে বেড়াতে যাবার প্রবল বাসনা জেগেছিল। আজকালকার স্মার্ট ফোন— এর ওয়েবসাইটে তো অনেক ভ্রমনীয় স্থানেরই সন্ধান মেলে কিন্তু এবারে একটি নতুন ভ্রমনীয় স্থানের আবিষ্কার করা সম্ভব হল। ভ্রমনীয় স্থানটি দেখবার জন্য খুবই উদ্গ্ৰীব হলাম। কতক্ষনে সেই স্থানে পৌঁছোব সেই উত্তেজনায় রাতের ঘুম উড়ে যাওয়ার অপেক্ষা রাখে না।
গত ১৯.২.২০২৩ তারিখ নাগাদ আমি সপরিবারে স্বামীনারায়ণ মন্দির দর্শনের প্রবল আকাঙ্খা নিয়ে রওনা হয়েছিলাম। ছুটির দিনে ছুটি কাটানোর আনন্দ একেবারেই আলাদা। এই মন্দিরের পৃথিবী জুড়ে নামডাক না থাকলেও লোকমুখে অতি প্রসিদ্ধ একটি মন্দির। মন্দিরটি মূলত ডায়মন্ড হারবারে অবস্থিত। এখান থেকে কিছুটা দূরেই হল পৃথিবী প্রসিদ্ধ গঙ্গাসাগর।এই বিষয়টি ছিল আমার অজানা। মন্দির খোলা থাকে দুপুর ১২:০০ টা অবধি। তাই আমরা সকাল ৮:০০ টা নাগাদ রওনা দিয়েছিলাম। মন্দিরটি যেহেতু মাঝেরহাট লাইনে এর জন্য রিষড়া—বালি পৌছোলাম। রবিবারে যেহেতু ট্রেন চলাচল একটু কম থাকে এরজন্য দমদমগামী বাসে করে একেবারে দমদম স্টেশনে পৌঁছে গেছি। মাঝেরহাট লোকালে চেপে অবশেষে গন্তব্যের দিকে পাড়ি জমানো গেলো। কিন্তু মাঝেরহাট স্টেশনটি অনেক দূরে। আর এই লোকালটি প্রচুর পরিমাণে স্টপিজ দিতে দিতে যায় বলে অনেক দেরি হলো।
কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে আমাদের মন্দিরে পৌছোতে অনেক কালবিলম্ব হল। মন্দিরের নির্ঘন্ট অনুযায়ী পৌছোতে না পারায় মনে একটা ক্ষুদ থেকেই গেলো। মাঝেরহাট স্টেশন থেকে কিছুটা হাটা পথে আপনি ২৩৫ নং বাস পেতে পারেন। মন্দিরটি কলকাতার আমতলা রোডে অবস্থিত। তাই ২৩৫ নং বাসে উঠে গেলে পৌঁছে দেবে একদম মন্দিরের স্বনিকটে। সময়মতো পৌছোতে না পারার আগেই মন্দিরের দ্বার নিজ সময়মতো ১২:০০ টার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। দূর্ভাগ্যবশতঃ ৩:০০ টে ঘন্টা একটি বাস স্টপে বসে গোবেচারার মতো বসে কাটাতে হলো। কারণ মন্দির আবার খোলে হচ্ছে বিকেল ৪:০০ টা নাগাদ। আর বন্ধ হয়ে যায় রাত ৮:০০ টা নাগাদ। অপেক্ষায় তিনটে ঘন্টা কাটল। বিকেল ৪:০০ টে বাজতেই মন্দিরের দ্বার উন্মুক্ত হল এবং মন্দিরে আস্তে আস্তে জনসমাগম শুরু হল। ধীরে ধীরে পৌঁছে গেলাম মূল মন্দিরের সামনে।
ওঃ! সেকি দৃশ্য। মনে হচ্ছে কোনো ভূসরগে এসে উপস্থিত হয়েছি। মন্দিরটিকে চাক্ষুষ দেখবার যে সুপ্ত ইচ্ছা ছিল সেটা আজ আমার পূর্ন হল। মন্দিরটির আশেপাশের পরিবেশ ও সৌন্দর্য আমাকে অত্যন্ত অভিভূত করল। মন্দিরের দুপাশে দুটো হাতি আপনাকে কোনো রাজপ্রাসাদে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে বলে মনে হবে। মন্দিরটিকে কেউ কেউ পৈলান মন্দির ও বলে থাকে। একটা কথা বলে রাখা দরকার এখানে, আপনি যখন বাসে উঠবেন তখন বলবেন যে আমি পৈলান মন্দির যাবো। বাস একদম আপনাকে পৈলান মন্দির এর নিকটেই নামিয়ে দেবে। মন্দিরের ভেতরের মূল দরজা বিকেল ৪ঃ৩০—৫ঃ০০ টার পর খোলা হয়। তার আগে পর্যন্ত মন্দিরের আশেপাশ ঘুরতে লাগলাম।
মন্দির প্রাঙ্গনের চারিদিকে ঘুরে দেখতে দেখতে অনেক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হল। এখানে আপনি গো সেবার জন্য কিছু অর্থ দান করতে পারেন। এই স্থানে বহু রকমের যে সবজি চাষ হয় সেইসব শাকসবজি আবার বিক্রি ও করা হয়। কিন্তু শাকসবজির মূল্য অনেক বেশি বলে কোনো শাকসবজি কেনার উপায় ছিল না।
মূল কথা হল এই মন্দিরের যিনি আরাধ্য দেবতা ভগবান স্বামীনারায়ণ তিনি ছিলেন একজন সাধক। তার অপর নাম ঘনশ্যাম পান্ডে। তিনি অযোধ্যার ছাঁপিয়া গ্ৰামে জন্মগ্রহণ করেন। তার আরও নাম রয়েছে যেমন— হরেকৃষ্ণ মহারাজ, শ্রী জি মহারাজ এবং শ্রীহরি। তিনি মাত্র ১১ বৎসর বয়সে কৈলাস পাড়ি দেন। এবং সিদ্ধিলাভ করবার ফলে নতুন নাম হয় “নীলকান্তমণি। ”
মূল মন্দিরে ঢুকে আপনি প্রথমে শিব পার্বতী গনেশ এবং তার অপর দিকে রাম ও সীতার বিগ্ৰহ দেখতে পাবেন। মন্দিরের ভেতর প্রবেশ করে ভগবান স্বামীনারায়ণ এর দর্শন করে মনের মধ্যে কেমন একটা ভক্তিরস উৎপাদিত হল।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে রাখি যে, মূল মন্দিরের ভেতর ফটো তোলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তাই আমরা মন্দিরে বেশিক্ষণ না থেকে বাইরে বেরিয়ে গেলাম। মন্দিরের আরেকটু পাশে আরো একটি মন্দির রয়েছে। সেই মন্দিরে প্রবেশ করে দেখতে পেলাম স্বামীনারায়ণ জির বংশধর ও নীলকান্তমণির জীবনযাত্রার কথা।
যেটির জন্য এই মন্দিরেএত লক্ষ ভক্তদের সমাগম সেটি হল আসলে “নীলকান্তমণির সোনার মূর্তি। ” এটির দর্শন প্রাপ্তির কারনেই দূরদূরান্ত থেকে এত ভক্তাদির সমাগম মন্দিরটিতে। মূল্য ৫০ টাকার বিনিময়ে আপনি মূর্তিটিকে স্নান করাতে পারেন।
পরিশেষে আমাদের যাত্রা এখন এর মতো সমাপ্ত হল। সন্ধ্যা ৬ঃ০০ টার সময় মন্দিরটি আলোক সজ্জায় সেজে ওঠে। সন্ধ্যার আলোকিত পরিবেশ এতটাই অপূর্ব সুন্দর যে ভাষায় প্রকাশিত হবার অভাব দেখা দেয়। আর বেশি দেরি না করে আমরা সবাই এবার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আমার মনে প্রানে চিরকাল এই ভ্রমণ ও স্বামীনারায়ণ মন্দির চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।