চারাগাছ
শিবানী কুন্ডু খাঁ
স্কুলের গণ্ডিতে পা ফেলল মতিন। চোখ-মুখে অদ্ভুত এক আনন্দের ছোঁওয়া । সমবয়সী ছেলেগুলো ফিসফিস করে বলল - "এ আবার কে রে , বাবা !"
ললিতা স্কুলে প্রথম দিন পৌঁছে দিয়ে এসেছিল । হেডমাস্টারমশাইয়ের কাছে বিনীত ভাবে ছেলেটাকে দেখভাল করার জন্য অনুরোধ করেছিল ।
হেডমাস্টার মশায় সেদিন তার কাছে পুরোটাই জেনেছিলেন অভিভাবকের মত । একটি লম্বা শ্বাসও ফেলেছিলেন তিনি । ললিতা চলে গেলে দেওয়ালে টাঙানো শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ফটোটির দিকে দৃষ্টি মেলে দিলেন।
মানুষের ভোগ সর্বস্বতা আজ কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে ! সুসম্পর্ক শব্দটা হারিয়ে যাবে হয়তো । ভোগ করার মানসিকতা -ভোগ অতৃপ্তি মানুষকে পশু বানিয়ে ছাড়ছে ।হাফ-বোতল জল খেয়ে খানিক স্বাভাবিক হয়ে সহকর্মীদের কাছে এলেন ।মতিন সম্পর্কে অনেক কথা বললেন ।সব শুনে নতুন ছাত্র মতিনকে সহযোগিতা করার জন্য সহকর্মীরাও একরকম অঙ্গীকার করলেন ।অতীতে এরকম বহু কাজই
তাঁরা স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে করেছেন । প্রবীণ শিক্ষক দিবাকরবাবু তো এ'ব্যাপারে নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারেন নিঃশেষে । ক্লাসে যেতে যেতে মনে মনে বললেন -" এ'চারাগাছও যত্ন পেলে মহীরূহ হতে পারে । "
দিবাকরবাবু খেলার ছলেই বাচ্চাদের পড়ান ।খেলার সুযোগ পেলে বাচ্চারা তো জটিলতার মধ্যেও আনন্দ খুঁজে নেয় আর ওই আনন্দ নিয়েই তারা পড়া সহজেই রপ্ত করতে পারে ।ভারী মজা পায় ছাত্ররা ।
ক্লাসে ঢুকেই নবাগতকে দেখে বললেন - "নাম কী ?"
উত্তর নেই ।
ঋষভ বলল " মতিন বাগদি ।"
"আমাকে দেখতে কী বাঘের মত ?"
মতিন চুপ থাকে ।
"আমাকে দেখতে ভালো না বলে কিছু বলছো না , তাইতো ?"
মতিন শুধু তাকাল ।
মাস্টারমশায় এবার বাচ্চার গলায় বললেন -"আমাকে বন্ধু করবে না মিস্টার মতিন ?"
মতিন এবার ঘাড় নাড়লো ভয়ে ভয়ে ।
"আচ্ছা , সবাই আমার বন্ধু তো ?"
একসঙ্গে সবাই হাঁ বলল ।
"বন্ধুর সঙ্গে মনের কথা খুলে বলা যায় ?"
" হ্যাঁ ।"
"আজ গল্প করি তাহলে। সাগরে জাহাজ
দেখেছো ?"
অনেকে হ্যাঁ বলল ।
"ট্রেনে চেপেছো ?"
সকলে হ্যাঁ বলল ।
"ট্রেনে উঠলে নামার জায়গা ঠিক করে নিতে হয় ?অর্থাৎ যাত্রাপথ ঠিক করতে হয় ,তাই তো ?"
মতিন গদগদ হয়ে বলল -" আমি সেবার প্রথম ট্রেনে চড়ি । নির্দিষ্ট জায়গাতেই নামতে পেরেছিলাম।
"গাছে চড়েছ কখনো ? গাছে উঠলে লক্ষ্য কী থাকে ?"
মতিন বলল- ফল নিয়ে নেমে পড়া ।
খুব ভালো । লক্ষ্য স্থির রাখতে হবে সকলকে । এ বিদ্যালয় একটি ফলন্ত বৃক্ষ। উঠো । লক্ষ্য নিয়ে লক্ষ্য পূরণে এগিয়ে যাও ।"
এখন থেকেই কি হতে চাও ঠিক করা দরকার ।
সুমন তার মায়ের কথা বললো ।তার মা তাকে ডাক্তার হওয়ার লক্ষ্যে অবিচল থাকতে বলে ।
" ঠিক"।
শুভ্র তার অফিসার হওয়ার কথা জানাল ।
"ভালো "।
এবার মতিনকে জিজ্ঞেস করলেন দিবাকরবাবু ।মূলত তার জন্যই এরকম একটা ক্লাসের পরিকল্পনা । মতিনের মাকে স্টাফ রুম থেকে দেখেছিলেন দিবাকরবাবু । বড্ড দুঃখী মনে হয়েছিল এমনিতেই। তার ওপর হেড স্যারের কাছে পুরো গল্পটাই শুনেছিলেন।
মতিন ড্যাবা ড্যাবা চোখ দুটো নিয়ে শুধুই তাকালো একবার স্যারের দিকে একবার ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে । স্যার খুব ভালবেসে হাসিখুশি ভাবে জিজ্ঞেস করলেন -"মিস্টার মতিন ,তুমি বড় হয়ে কী হতে চাও ?
"ঝাড়ুদার হবে" শুভ্র উঁচু গলায় বলে ।
মতিন তাকালো । শুভ্র ওদের পাড়ার ছেলে ।বড়
দালান বাড়িতে থাকে ওরা ।গাড়ি আছে দুটো। স্যার পিঠে হাত বোলালেন পরম মমতায়- " কিছু একটা তো হতে চাও , সেটা বন্ধু জানতে চাইছে বলো ।"
মতিনের চোখ এবার বড় বড় হয়ে উঠল ক্ষণিকের জন্য । তারপর বেঞ্চের দিকে মুখ নিচু করে বলল- "পুলিশ "।
"বাহ ! খুব ভালো ।"
চোখমুখ শক্ত হল তার ।বাবার জন্যই তাকে পুলিশ হতে হবে ।তারপর সে গড়গড় করে অনেক কথা বলে চললো ।তার বাবার অমানবিক নিষ্ঠুরতার কথা । বাবা তার জন্মের পরেই মাকে ছেড়ে অন্য কোথাও অন্য কোনখানে বাসা বেঁধেছে।
মা সর্বস্ব খুইয়ে একা লড়াই দিয়ে তাকে একটু বড় করেছে ।এখন অবস্থা সঙ্গীন ।সুগার প্রেসার খুব জব্দ করেছে ।কাজ করতে পারে না লোকের বাড়িতে। লক্ষী ভান্ডারের ক'টা টাকা ওষুধ কিনতে শেষ হয় । সুরেশ মিত্রের বাড়িতে মতিন যায় মায়ের বদলি দিতে । এঁটো থালা ধুয়ে দেয় ।ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠল মতিন -"ওখানের হোটেল বয়রা টিটকারি করে কখনো মা কখনো বাবাকে নিয়ে ।
আমার খুব রাগ হয় -কষ্টও।যেতে মন চায় না ।
কিন্তু মা আমি দুবেলার খাবার পাই ও'কাজের বিনিময়ে ।"
পিরিয়ড ওভারের ঘন্টা পড়লে দিবাকরবাবু বললেন -"পরেরদিন বই খাতা কলম নিয়ে যেও আমার সাথে দেখা করে ।"
তারপর সজল চোখে ক্লাস থেকে বেরিয়ে এলেন ও প্রধান শিক্ষকের সহযোগিতায় ছোট্ট মতিনের স্বপ্ন পূরণে উদ্যোগী হলেন ।
মনে মনে বললেন -" চারাগাছ সঠিক পরিচর্যায় বৃক্ষ না হয়ে পারে না !"