স্মৃতির ভিড়ে                                  

 লাজবী মুখার্জী  

                                                                                     সুরঞ্জন যেন আজ পৃথিবীতে বড্ড নিঃসঙ্গ, পৃথিবীর প্রত্যেকটি সঙ্গহীন মানুষের মতোই তার মনের ছবিটাও যেন পৃথিবীর প্রত্যেকটি কোণের আয়নাতে ফুটে উঠছে।

 

চোখের জলে স্মৃতিগুলো ও কেমন যেন ঝাপসা হয়ে আসছে! এই ওর একাকীত্ব অবসর যাপনের একটা ভীষণ খারাপ দিক, চোখটা সবসময় জলে ভরে দেয়!                                                                  চোখের জলের স্রোত তাকে ভাসিয়ে অন্য কোনো কূলে নিয়ে যায় যেখানে অতীতের সূক্ষ, সুন্দর স্মৃতিগুলোকে সে ইচ্ছা করলেই ছুঁয়ে দেখতে পারে! শ্রাবণের ধারার মতো তার জীবনও নতুন ভাবে স্বপ্ন, আশা, ভালবাসাতে পূর্ণ করতে এসেছিল স্বরচিতা। স্বরচিতা সুরঞ্জনের প্রিয়তমা স্ত্রী যার নাম সুরঞ্জন তার মনের খাতায় রচনা করেছিল তখন থেকেই যখন ছোট বোনকে কলেজে দিয়ে আসার পথে ওই কলেজেরই লাইব্রেরীর পথে একটা আধখোলা চুলের, কাজল কালো শ্যামবর্ণ রঙের মেয়ের চোখে নিজেকে হারিয়ে ফেলে! সেই চোখের আলো তেই যেন সেদিন থেকেই সুরঞ্জন তাদের জীবন দীপ টা একটু একটু করে জ্বালতে শুরু করেছিল। কারণে অকারণে সুরঞ্জনের মন যেন তার অদৃশ্য ছবি আঁকতো, যাকে সুরঞ্জন একান্ত নিজের করে

 

পেতে চাইতো তবে সুরঞ্জনের প্রিয় পোষ্য সন্দেশ মনে হয় সুরঞ্জনের মনের এই গভীর একাকিত্মতা, তার স্বপ্নে ভেসে বেড়ানোর অভ্যাসটা অনুভব করতে পারতো তাই তার স্নিগ্ধ ভালোবাসা দিয়ে সুরঞ্জনকে সে স্বপ্নরাজ্য থেকে নামিয়ে আনতো প্রকাশ্য বাস্তবের রাজপথে। এইভাবেই যেন প্রথম ভালোলাগা বা ভালোবাসার পাদপদ্মে নিজেকে সে উজাড় করে দিত প্রতিদিন। বছর দুয়েক পর এই স্বপ্ন সত্যি করে সুরঞ্জনের ঘরের প্রতিটি কোণ আলো করে সুরঞ্জনের স্ত্রীর পরিচয়ে এসেছিল স্মরচিতা। জীবনের প্রত্যেকটি দিনই যেন সুরঞ্জন ও স্বরচিতার ভালোবাসায় হয়ে উঠেছিল একটা ভালোবাসায়, স্বপ্নেমোড়া স্বরচিত কবিতা। এই দিনগুলো যে শুধুই ভালোবাসার রঙে রাঙা ছিল তা নয় জীবনের হাজারও উত্থান, পতন, ভালোমন্দ, লড়াই, এই সব কিছুতেই পরিপূর্ণ ছিল। আসলে, একসাথে, হাতে হাত রেখে বেঁচে থাকার জন্য জীবন যে শর্ত গুলো দেয় সেগুলোকে আপন করেও দিনের শেষেও নিজেদের কে একে অপরের মধ্যে খুঁজে পেত সুরঞ্জন ও স্বরচিতা।                                                                                             সুরঞ্জনের মুখে হাসি আর ধরছিল না সেইদিন, খুশির সমস্ত সীমানা পার করে যেন সারা পৃথিবীকে তার জানাতে ইচ্ছা করেছিল সেইদিন যেদিন সে নিজে জানতে পেরেছিল তার ছোট্ট মনবাগানে প্রথম ধরেছে কলি অর্থাৎ তার প্রথমবার বাবা হবার খবরটা। সেইদিন যেন সুরঞ্জনের অন্তরস্থ শিশুটি ও জাগ্রত হয়ে উঠেছিল। বাচ্চা ছেলেদের মতন সে নেচেছিল। সারা পাড়া মিষ্টি বিতরণ করে বেড়িয়েছিল। নিজেদের ভালোবাসার ঔরষের ফুলটিকে প্রস্ফুটিত করার কাছে বোধহয় পৃথিবীর সকল আনন্দ ফিকে হয়ে যায়!                                                         স্বরচিতার  দশ মাসের অনেক লড়াইয়ের পর প্রস্ফুটিত হল তাদের প্রথম ভালোবাসার ফুল তাদের পুত্র স্বপ্নময়। অনেক স্বপ্ন, আশা ও ভালোবাসায় সৃষ্ট বলে স্বরচিতা ও সুরঞ্জন তাদের পুত্রকে এই নাম দিয়েছিলেন। এরপর তো সংসার জুড়ে শুধুই ভালোবাসার বিচরণ। আসলে, একজন ছোট সদস্যই পারে একটা পরিবারকে  পূর্ণ করতে।  এরপর সেই সন্তান মানুষের মতো মানুষ করা, তাকে বড়ো করা, তার স্কুল, কলেজ ইত্যাদি তে একজন মা যেমন সবসময়ই নিজেকে সমর্পণ করে দেয়, তেমনি স্বরচিতাও নিজেকে সমর্পণ করে দিয়েছিল মা হবার কঠিন দায়িত্বে। মাঝে মাঝেই সুরঞ্জনের ভারী রাগ হতো, অভিমান হতো বললেও চলে! প্রিয়তমা স্ত্রী যেন সন্তান স্নেহে বিভোর তার আর প্রেমিক স্বামী সুরঞ্জনের প্রতি লক্ষই থাকতো না, এই নিয়ে কত অভিমানই না করেছে সুরঞ্জন! মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে নিরুদ্দেশ হয়ে স্বরচিতার আবেগ, ভালোবাসার পরীক্ষা নিতেও ছাড়েনি। তবে, স্বরচিতা এমন ই একজন ব্যক্তিত্বের মানুষ সে তার প্রেমিক স্বামীর এই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা কে তার প্রেমের অলঙ্কার হিসাবেই গ্রহণ করতো সবসময়।                                                      সমুদ্রের স্রোতের মতো সময় গুলো বয়ে যায়, স্বপ্নময় স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে পা রাখে কলেজে, তাকে পড়াশুনার সুবাদে পা রাখতে হয় নিজ

 

শহরের বাইরে অন্য শহরে। সুরঞ্জন তখন কর্ম জীবন থেকে অবসর নিয়েছে সবে মাত্র। অবসর গ্রহণের পর যেন প্রতিটি ঘরে বৃদ্ধ দম্পতিদের এক অন্য ভালোবাসা গাঁথা, নির্ভরতার জীবন শুরু হয়। বয়সকাল শুধুই একে অপরের পাশে থাকার অঙ্গীকারে আবদ্ধ করে। বেঁচে থাকার জন্য একসঙ্গে নিঃশ্বাস নেওয়া টা তখন ভীষণ জরুরী হয়ে পড়ে! এভাবেই সময়ের ভেলায় ভেসে চলছিল বৃদ্ধ দুটি সম্পর্ক।                                                                                                   একদিন হঠাৎই স্বরচিতা প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন, সুরঞ্জন যেন দিশেহারা হয়ে পড়েছিল, একা মানুষ কী যে করবে আর কী করবে না ঠিক ভেবে পাচ্ছিল না! স্বপ্নময় তখন সদ্য একটা নতুন  চাকরি পেয়েছে তাই তার মা স্বরচিতা স্বপ্নময়কে তার অসুখের খবর জানাতে বারণ করেছিলেন, স্ত্রীর কথামতো সুরঞ্জনও ছেলের কাছে মায়ের অসুখের কথা গোপনই রেখেছিলেন। আসল সত্যিটা তখনও স্বরচিতারও অজ্ঞাতই ছিল।সত্যিটা সুরঞ্জন স্বরচিতার কাছে তখনও

 

গোপনই রেখেছিলেন, পাছে তার প্রিয়তমা স্ত্রী এই আঘাত সহ্য করতে না পেরে যদি প্রবলভাবে ভেঙে পরেন! এই সকল কিছু চিন্তা করেই সুরঞ্জন যেন প্রত্যেকদিন ঈশ্বরের কাছে ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছিলেন! নীরবে চোখের জল ফেলতেন, বুকটা ফেটে যেতো, তবুও মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলতে পারতেন না, এমন নীরব যন্ত্রণার সাথে প্রত্যেকদিন লড়াই করতো সুরঞ্জন। কারণ, একটাই ভয় তাকে তাড়া করে বেড়াতো সবসময়, স্বরচিতা যে যকৃতের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিল। একদম শেষ ধাপ, সর্বগ্রাসী এই রোগ অনেকদিন আগেই স্বরচিতার শরীরকে গ্রাস করেছিল তবে তা বোঝা যায়নি এই কথা জানতে পারলে স্বরচিতার জীবন দীপের সলতেটা হয়তো বড় তাড়াতাড়ি নিভে যাবে। সুরঞ্জন প্রত্যেকদিন দেখতো কাজল কালো শ্যামবর্ণ রঙের তার প্রাণপ্রিয়াকে। কী ভাবে প্রত্যেকদিন মারণ রোগটি একটু একটু করে গ্রাস করে তার নিজের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল স্বরচিতাকে!

 

খসখসে চামড়া, রুগ্ন শরীর যেন স্বরচিতাকে সাজানো বাগানের গোলাপ থেকে ঝরা পাতায় পরিণত করেছিল।তবুও সুরঞ্জনের ভালোবাসা একফোঁটাও কমেনি। কারণ রূপের প্রেমে নয় বরং সুরঞ্জন স্বরচিতার মনের সাথে সহবাস করতো।                                                                                         জীবনের শেষ কিছুদিন পূর্বেই স্বরচিতার শরীর প্রচন্ড খারাপ হয়েছিল। তখন স্ত্রীর কাছে করা সমস্ত প্রতিজ্ঞা ভেঙেই সুরঞ্জন বাধ্য হয়েছিলেন ছেলে স্বপ্নময়কে খবর দিতে। স্বপ্নময় সব কিছু জানার পর দুদিনের মধ্যে চলে আসে তার নিজ বাসভবনে। স্বপ্নময় যখন পৌঁছেছিল তখন দেখেছিল তার মায়ের মাথাটা তার বাবার কোলে রাখা, তিনি বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছেন আর তার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে প্রবল অশ্রুধারা, স্বপ্নময়ের বাবা অর্থাৎ সুরঞ্জন নীরব হয়ে দেখছিল তার স্ত্রীর দিকে, তার চোখ থেকেও প্রবাহিত হচ্ছিল প্রবল অশ্রুধারা, তাদের দুজনের অশ্রুধারা যে একসঙ্গে মিলিত হয়ে কোন স্রোতের পথে বাঁক নিচ্ছিল তা অদৃষ্ট ছাড়া বোধহয় কাওরই জানা

 

ছিলনা! স্বপ্নময় মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে, সুরঞ্জন স্বপ্নময়কে বলেছিল একটু জল তার মায়ের মুখে দিতে, স্বরচিতার মুখে একটু খানি জল দিয়েছিল স্বপ্নময়। সন্তানের হাতের এইটুকু জলের অপেক্ষাতেই বোধহয় নিজের প্রাণপাখিটাকে খাঁচা ছাড়া করতে পারছিলেন না স্বরচিতা।               ‌                                                                                                  

 এর কিছুক্ষণ পর সারা ঘর জুড়ে শুধুই নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিল! স্বরচিতা এক জীবনের সমস্ত পাঠ সম্পূর্ণ করে হেঁটে যায় পরপারে আর এক অন্য জীবনের পথে। 

                        

মাঝে কেটে গেছে অনেকটা সময়। চুলে অনেকটাই পাক ধরেছে সুরঞ্জনের। এখন সে দাদু হয়ে গেছে । তবে, কর্মসূত্রে ছেলে স্বপ্নময় ও তার স্ত্রী দেশের বাইরেই থাকে। তাই নাতনির ভালোবাসার পরশ পেতে সুরঞ্জন অনেকটা বঞ্চিত ।তবে , মোবাইল ফোন নামক যন্ত্রটির কল্যাণে মাঝে মাঝে পর্দার ওপারেই সে যেন নাতনিকে স্পর্শ করে তার

 

নরম তুলতুলে হাতের আদরে নিজের বার্ধক্যকে সমৃদ্ধ করে।  এই প্রাণের থেকে প্রিয় নাতনিটির মধ্যে সুরঞ্জন যেন তার প্রিয়তমা স্বরচিতার প্রতিচ্ছবি দেখতে পায় তাই সখ করে স্বরচিতার নামের সঙ্গে মিলিয়ে নাতনির নাম রেখেছে সঞ্চয়িতা।                                                                           বার্ধক্যময় জীবন যেন মাঝে মাঝে সুরঞ্জনকে বড্ড নিঃসঙ্গতায় বেঁধে ফেলে। তখন সে একলা হয়ে পুরোনো স্মৃতিগুলোর সাথে গল্প করে, অদৃশ্য ছবির মত স্বরচিতা যেন বারবার ফুটে ওঠে সুরঞ্জনের মনের খাতার পাতায়। ঠিক যৌবনে নিজের ভালোবাসা যেমন সুরঞ্জনকে কল্পনার জগতে ভাসিয়ে নিয়ে যেত বৃদ্ধ বয়সেও সুরঞ্জন যেন স্বরচিতাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধতে চায়, তখনই কঠিন বাস্তব এসে সুরঞ্জনের কানে কানে জানান দিয়ে যায় স্বরচিতা নতুন ভাবে স্বরচিত হয়েছে আকাশে, বাতাসে। মন মানতে  চায়না তবুও মনকে মানাতে হয়। সুরঞ্জন স্মৃতির ভিড়ে নিজেকে হারিয়ে অতীত ও বাস্তবের সাথে প্রতিদিন লুকোচুরি খেলে। মাঝে মাঝে উদাস হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে ভাবে, কবে তাঁর

 

ঠিকানায় চিঠি আসবে অদৃষ্টের, জীবনের পরপারে হেঁটে যাবার আমন্ত্রণে! যেখানে, সে আবার মিশে যেতে পারবে তার স্বরচিতার সঙ্গে প্রেমের জোয়ারে, ভালোবাসা, স্বপ্ন আর নির্ভরতার অলঙ্কারের তারা বাঁধবে এক অদৃশ্য সংসার। এই সব ভাবনা সুরঞ্জনকে ক্ষণিক তৃপ্তি জোগায় তারপর আবারও সে হারিয়ে যায় স্মৃতির ভিড়ে।।