মহ: রিজওয়ান পারভেজ
মহ: রিজওয়ান পারভেজ
অদ্য মিলন ক্ষণ
সালটা ১৯১১, প্রচণ্ড গণআন্দোলনের ফলশ্রুতিতে বঙ্গভঙ্গ রহিত হয়।তবুও তার দামামা তখনও বেজে চলেছে ভারতবর্ষের আকাশে-বাতাসে।আগুনের শেষ স্ফুলিঙ্গটুকু বাংলার মাটিতে তখনও বর্তমান।ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যারা যুক্ত,যারা স্বপ্ন দেখে চলেছে দেশমাতৃকার উদ্ধারের-তাদেরকে পুরস্কার স্বরূপ দেওয়া হচ্ছে দ্বীপান্তর অথবা ফাঁসি।
এমতাবস্থায় বঙ্গদেশের কোনো এক অখ্যাত গ্রামের দরিদ্র কৃষক নরেন ঘোষালের ছেলে অমৃত দেশমাতৃকার উদ্ধারের কাজে অংশগ্রহণ করল।স্থানীয় "যুব ভলেন্টিয়ার্স"সংগঠনের প্রধান অজিত বসুর প্রথম দেখাতেই অমৃত কে পছন্দ হয়।অবশ্য প্রথম দেখাটি হয় কিঞ্চিৎ অন্যরকম ভাবে।অমৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র।"দর্শন" তার বিষয়।সে জ্ঞান,আলোচনা,শিক্ষার বাইরে কোনো কিছু মানে না-বিশ্বাস করে না।দেশের মাটির প্রতি তার টান অগাধ।বিভিন্ন সেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে সে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে।গতবছর কলেরায় যখন গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হচ্ছে তখন অমৃত নির্দ্বিধায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে তাদের সেবা করেছে মৃত্যুকে উপেক্ষা করে।বৈশাখ মাসের এক বিকেলে অমৃত ও তার কিছু সহপাঠী ফিরছিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।পথে একটি ইউরোপিয়ান ক্লাব পড়ে।তার সদর দরজায় সাইনবোর্ডে লেখা ছিল "Dogs and Indians are not allowed"।অমৃত হঠাৎ রাস্তা থেকে একটি পাথর তুলে নিয়ে সজোরে আঘাত করে কাঠের সাইনবোর্ডটির উপর।তারপর তার সহপাঠীরাও এগিয়ে আসে।এতজনের মিলিত প্রয়াসে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই কাঠের সাইনবোর্ডটি দ্বিখণ্ডিত হয়ে মাটিতে পড়ে।আওয়াজ পেয়ে ছুটে আসে দায়িত্বে থাকা ইংরেজ কর্মচারীরা।সেদিন অজিত বাবু ওদের সাহায্য করেন সেখান থেকে নিরাপদে পালিয়ে যেতে।খুব অল্প দিনেই অমৃত "যুব ভলেন্টিয়ার্সের" একজন সক্রিয় সদস্য হয়ে ওঠে।তখন তার একমাত্র উদ্দেশ্য দেশমাতৃকার স্বাধীনতা।দেশের জন্য নির্দ্বিধায় প্রাণ বিসর্জন দিতেও সে প্রস্তুত।
সকলের অগোচরে আরও একটি স্বপ্ন সে দেখেছিল।সেটা সে প্রকাশ করেনি।যখনই সে ভেবেছে তার কথা - গোলাপী আভা ফুটেছে তার মুখে।যখনই সে তার সামনে এসেছে অমৃত চোখ নামিয়েছে,তার ঠোঁটের কোণে লেগেছে এক চিলতে হাসি।মেয়েটি অমৃতের গ্রামের মহাজন কৈলাস প্রামাণিকের মেয়ে শ্রুতি।শ্রুতি প্রত্যেকদিন বিকেলে অমৃতের বাড়ির পিছনের দীঘিতে জল নিতে আসে।সে জানেনা প্রত্যেকদিন একজোড়া চোখ দূরের ওই বাড়িটির জানলা থেকে নির্লিপ্তভাবে চাতকের ন্যায় তার পানে চেয়ে থাকে।সে চোখে আছে প্রেম,ভয়-লজ্জাহীন দুর্নিবার বাসনা,তাকে কাছে পাওয়ার তীব্র আশা।গোধূলির শেষ রক্তিম আভা,প্রকৃতি,আকাশ-বাতাস সাক্ষী থাকে এই বঙ্গ তরুণের নিঃশব্দ ভালোবাসার।
একদিন অমৃত সাহস করে বাড়ির পিছনের খিড়কিদরজা দিয়ে বেরিয়ে প্রায় নিঃশব্দে উপস্থিত হয় শ্রুতির সামনে।শ্রুতি ততক্ষনে কলসি ভর্তি জল নিয়ে বাড়ি ফিরছে। হঠাৎ সামনে অমৃত কে দেখে সে চোখ নামিয়ে নেয়।তার মুখ জুড়ে রক্তিম আভা ফুটে ওঠে।সেই শুরু তারপর প্রায় প্রতিদিন দুই হৃদয়ের নিভৃতে মিলনের সাক্ষী থাকে গোধূলির অস্তগামী সূর্য।
এদিকে ইংরেজ সরকারের অত্যাচার মাত্রা ছাড়িয়েছে।তাদের ভয়ে মানুষ কোণঠাসা।মেয়েদের মানসম্মান ধূলায় মিশিয়েছে তারা।"যুব ভলেন্টিয়ার্স" সিদ্ধান্ত নিল কিছু করা আবশ্যক।এই অত্যাচারী ইংরেজ সরকারকে ভয় পাওয়ানোটা খুব জরুরী।প্রধান অপারেশনের জন্য নির্বাচিত হল অমৃত এবং তার দুই সঙ্গী আব্দুল আর শঙ্কর।অপারেশন কী বিষয়ে সেটি শুধু জানলেন এই কাজের জন্য নির্বাচিত সদস্যগণ এবং "যুব ভলেন্টিয়ার্সের" প্রধান অধিকর্তা অজয় বসু।বাকিদের থেকে তা গোপন রাখা হল।তবে অপরেশনের আগের দিন রাতে চোরাপথে তিনটি দেশি পিস্তল এসে স্থান পেল "যুব ভলেন্টিয়ার্সের" অফিসে।
অমাবস্যার নিকষ কালো অন্ধকার।মাঝরাতে দূরে গ্রামের মাঠে তিনটি টর্চের আলো জ্বলে উঠল। বোঝায় যাচ্ছে তিনজন স্টেশনের দিকে চলেছে।হয়ত শেষ রাতে শহরে যাওয়ার ট্রেন ধরবে।হঠাৎ পিছনে বেশ কিছু লোকের পায়ের শব্দ এবং জোরালো টর্চের আলোয় তিনজনের চোখ ধাঁধিয়ে গেল।নিস্তব্ধ রাত্রির নিরবতা বিদীর্ণ করল গুলির আওয়াজ,নির্মল বাতাসে মিশে গেল বারুদের উগ্র গন্ধ। সংগঠনের কেও বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।পরদিন সকালে আকাশবাণী কলকাতায় সম্প্রচারিত হল-"গতকাল রাতে তিনজন বিপ্লবী পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন।তারা কোনো গোপন পরিকল্পনা চরিতার্থ করার তাগিদে শহরে আসার চেষ্টা করছিলেন।মাঝপথে পুলিশ তাদের নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টা করলে দুই দলের মধ্যে গুলির লড়াই শুরু হয়".................
তারপর কেটে গেছে ছয়টি মাস।সেদিনের মত আজও অমাবস্যার কালো চাদরে ঢেকে আছে প্রকৃতি।অমৃতের বাড়ির সদর দরজায় আওয়াজ হল।ছেলে চলে যাওয়ার পরে অমৃতের মা শয্যাশায়ী এখন-তখন অবস্থা।অমৃতের বাবারও শরীর ভালো যাচ্ছে না আজকাল।তারা এখনও বিশ্বাস করতে পারেননি সেদিন রাতে অমৃত সেই বিপ্লবী দলের সদস্য ছিল।অমৃতের বাবা কোনোমতে সদর দরজা খুলে দিলেন।নরেন ঘোষাল নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না।এত আশ্চর্য তিনি জীবনে এই প্রথম হলেন,খুশিতে তার চোখের কোণ বেয়ে জল নেমে এল।তার চোখের সামনে অমৃত দাঁড়িয়ে।সেদিন রাতে আসলে দুই বিপ্লবী শহিদ হন।অমৃত কোনোমতে প্রাণ বাঁচিয়ে শহরে পালায়।ইংরেজ সরকার এই খবর গোপন করে।অমৃত কে দেখে যেন তার মা নবজীবন ফিরে পেল।পুলিশের ভয়ে অমৃতের বাবা-মা ছেলেকে একপ্রকার লুকিয়ে রাখলেন ঘরে।কিন্তু অমৃত শ্রুতির কথা জিজ্ঞাসা করলেই তারা এড়িয়ে যান।শ্রুতিও আজকাল দীঘিতে জল নিতে আসেনা।সেদিন বিকেলে সে তার মাকে শ্রুতির কথা জিজ্ঞাসা করল।
সে বলল- "মা আমি বাড়ির বাইরে বেরোতে পারছি না। শ্রুতিও এখন আর আসেনা। ও কোথায় মা বলো"।
অমৃতের মা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে বললেন - " শ্রুতি আর নেই বাবা"।
অমৃত - "নেই মানে? কোথায় গেছে"?
অমৃতের জানার কথা নয় তার মৃত্যুর কথা শুনে শ্রুতি প্রায় মানসিক ভারসাম্য হারায়।গতমাসে দশমীর দিন মা আর শ্রুতির বিসর্জন একইসঙ্গে হয়।হতভাগী দীঘির জলেই প্রাণ দিল।এই দীঘির পাড়েই তো অমৃতের সঙ্গে তার প্রথম দেখা।এই স্থান তার খুব প্রিয়।পরদিন সকালে শ্রুতির দেহটা দীঘির জলে ভেসে উঠেছিল।প্রথম দেখতে পান অমৃতের বাবা।
আজকাল অমৃত সারাদিন দীঘির পাড়ে বসে থাকে।দাড়ি না কামিয়ে দড়িটাও বেড়েছে।মাথার চুল উস্কখুস্ক।গায়ের জামা-কাপড় ময়লা।বিকেলের দক্ষিণা বাতাসটার জন্য সারাদিন অপেক্ষা করে সে।সে বাতাস যেন শ্রুতির বার্তা বয়ে নিয়ে আসে।সে আশেপাশের প্রকৃতিতে - বাতাসে অনুভব করতে পারে শ্রুতি কে।শুধু সে দৃশ্যমান নয়।যেন দৃশ্য আর অদৃশ্যের সীমারেখায় দাঁড়িয়ে আছে অমৃত।ইহলোক তার চোখে যেন কোনো অদৃশ্য পর্দা বেঁধে রেখেছে।পর্দা সরে গেলেই প্রকাশ পাবে ওপারের সবকিছু।
একদিন সকালে গ্রামের ময়রা হারু দীঘির পাশ দিয়ে যাচ্ছিল।সেই প্রথম দেখল দীঘির মাঝখানে একটি লাশ ভেসে উঠেছে, হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন আমাদের তরুণ বিপ্লবী এবার ছুটি নিলেন।দেশমাতৃকা আঁচল পেতে তার সন্তান কে গ্রহণ করলেন।এবার সে একটু নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নিক।ওদিকে আবার শ্রুতি অপেক্ষায় ছিল দীর্ঘদিন।এখন তো অমৃতের কাছে সবই দৃশ্যমান।দৃশ্য এবং অদৃশ্যের "সীমারেখা" সে অতিক্রম করেছে।