জলজ্যান্ত
অলভ্য ঘোষ
ভেবে ছিলাম অনেক রাতে বাড়ি ফিরবো এলোমেলো ঘুরে বেড়ানোর পর; একদিন রাত
একটায় টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপো থেকে হেঁটে বাড়ি ফেরার পথে টেকনিশিয়ান স্টুডিও ডিঙ্গিয়ে এগোচ্ছি শীতের নিশুতি রাত জনমানব নেই;গাড়ি গুলো মাঝে মাঝে পাশ থেকে এত গতিতে যাচ্ছে তার হাওয়া লাগছে গায়ে।হাত দেখালেও কেউ দাঁড়াবে না;যেন এক্ষুনি চাপা দিয়ে যাবে এমন ভাবে যাচ্ছে।রাস্তার কুকুর আর আমি!আমিই আমার প্রেমিকা হয়ে মনের সাথে কত গল্প,বিতর্কিত উপন্যাস ,সিনেমার চিত্রনাট্য গোড়ে নিতে নিতে বাড়ি ফিরি শহরের মুখরতার অবসান হলে আমার শুরু হয় প্রেম।এই প্রেমই আমায় বাঁচিয়ে রাখে নিজের ভেতরে; এই ব্যস্ত পৃথিবীতে নিজেকে নিজের মত এক কোনে আড়ালে আবডালে লোকচক্ষুর অন্তরালে এক অদৃশ্য পৃথিবীতে অশরীরী মানুষ করে।আমি কেমন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি ডিভোর্স দেওয়া বৌয়ের মতো ফেলে দেওয়া মোবাইল টা আবার বইছি ;ফোন কল,ম্যাসেজ,ফেসবুক.......কেমন আছো?......কি করছ?.......খেয়েছ?........ডং ডং করে বৈদ্যুতিক বার্তা আওয়াজ দেয়; মাথার ভেতরে যেন হাতুড়ি পেটা চলে।ব্যস্ত মানুষ গুলোর অবসরে পোশাকি কথার উত্তর দিতে গিয়ে।আমার আমি যে প্রেমিকা হাজার ভাবনা ভিড় করে নিয়ে এসেছিল মস্তিষ্কের ভেতরে খুইয়ে যায় বুদবুদের মত।হাজার মন্তব্যের উত্তর দিতে গিয়ে আমার দিন ফুরায়।সোনার খাঁচায় দুধভাত খেয়ে মরা জঙ্গলি তোতা পাখিটার মত আমি রোজ মরি আমার বন্য জীবন থেকে তোমাদের নাগরিক সভ্য মানুষ হতে গিয়ে।অবসাদ গ্রাস করে;নেই কিছু নেই;তোমাদের সবই সাজানো অ্যাকুরিয়ামের সমুদ্র তোমরা রঙিন মাছ।আমি বিবর্ণ রংচটা বলতে পারো বলতে পারো মনোরোগী আপত্তি নেই!আমি তো আমার মত।
সেই শীতের মধ্য রাতে কী হয়েছিল জানো?
রাস্তার রেলিংয়ের পাশে চট ,ফ্লেক্সের হোডিং ব্যানার আর কাপড় ছেঁড়া দিয়ে তৈরি ছোট্ট তাঁবুর মত ঘর।দুজন লোকও সে ঘরে ঘুমানো কঠিন মনে হয়।ঘর টা দুলছিল।জানি না ও ভাবেই পৃথিবী দোলে নাকি আহ্নিক গতি বার্ষিক গতি তে।ঘরের ভেতর শীৎকার ভেঙে যে উষ্ণ অভ্যর্থনায় নারী তৃপ্তির শিহরণ সূচক 'ইস্' 'আঃ' 'উঃ' ধ্বনি; জানান দিচ্ছিল তা সকলের জানা।কেবল জানা নেই এর ভিতর থেকেই আমরা জন্মেছি।মহাপুরুষ কাপুরুষ সকলেই।এটা আমরা ভুলে যাই।একটা কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে শীতে।আর তার ঠিক সামনে একটা থার্মোকলের পাটাতনের ওপর রাস্তার পাশে সিঁড়ি ভাঙা ছোট থেকে বড় সাজাও অঙ্কের মত বসে তিনটে দেব শিশু।ফুটপাতের যিশু!বড়
দিদিটার বয়স বছর চার পাঁচ,ছোটটা আরও ছোটো।মাঝারিটার কোলে ছোট টা আর বড়টার কোলে মাঝারিটা শীতে কুঁকড়ে কাঁপছে
আর ঘুমে ঢুলছে।ওই টুকু বয়সেই বটবৃক্ষের মত দিদিটার আচ্ছন্নতায় ছোট ভাইটার প্রতি হাতের আঁকশিতে ঢিল পড়েছে।ঘুমে ভাইটা ফুটপাত থেকে রাস্তার দিকে ঝুঁকে মনে হচ্ছে এই পড়ে যাবে।
পিঁপড়ের বাসার মত ছোট্ট ঝুপড়িটায় ওদের মা বাবা তখনো ব্যস্ত শরীর মিলনে;হয়ত সেই মিলন মেলায় আসবে ওদের চতুর্থ ভাই বা বোন।
আমার মনে হল ছেলেটি ফুটপাত থেকে পিচ রাস্তায় পড়ে গেলে কপালটা না ফাটলেও আলু হয়ে যাবে।তাই এগিয়ে গিয়ে যেই না ঠিক করে বসাতে গেলাম বাঘের শাবকের গায়ে হাত দিলে যেভাবে হিংস্র হয়ে ওঠে বাঘিনী; কিংবা নিরীহ শালিকের বাসায় চিল ছোঁ মারলে যেমনটি শালিক মরিয়া হয়ে ওঠে ছানা বাঁচাতে;তেমনি তেড়ে ফুঁড়ে চেঁচিয়ে উঠেছিল ওদের দিদিটি।
...বেরো.....বেরো এখান থেকে।
অদূরেই পড়ে থাকা একটি ভাঙ্গা টিউব-লাইট নিয়ে আমার দিকে তাক করে।সত্যি-ইতো মধ্যরাতে সহানুভূতি দেখাতে যাওয়া আমি অপরিচিত লোকটা মাতাল, ছেলেধরা, শিশুর যৌন শিকারি অনেক কিছুই হতে পারি।ওই চার পাঁচ বছরের মেয়েটা জানে এই রাস্তার পাশে তাদের কিকি হেনস্তার সম্মুখীন হতে হয়।আর এই বাস্তব শিক্ষাই তাদের শিখিয়েছে আত্মরক্ষারও পদ্ধতি।
অবাক কাণ্ড এত কিছুর মধ্যেও তাদের বাবা মা বেরল না।মনে হয় দুজনেই চড়া নেশায় ছিল।
আজ বহুদিন পর সেই বাঘিনী মেয়ে টাকে আবার দেখলাম আর একটু বড়ো হয়েছে সে। বাবুদের ছেলের ফেলে-দেওয়া ড্রয়িং বুকের সাদা পাতায় ছোট্ট একটুখানি পেনসিল দিয়ে কি যেন আঁকছে।কাছে গিয়ে দেখি শিব,দুর্গা,কালী।
একবার মনে হল বলি মানুষ আঁক,এরা সব
মিথ্যে মেকি সত্যি তুই জলজ্যান্ত বাস্তব।চিৎকার করে সে কথাটা বললে হয়তো লোকে পাগল বলবে।না হলে হয়তো লাঠিসোটা নিয়ে তেড়ে আসবে।ধর্মের শিশ্ন বড় সেনসিটিভ।সহজেই সিডাকশন ঘটে।গালিব তুমি কি মুসলমান না মানুষ?কবির,লালন তুমি হিন্দু না মুসলমান?নাকি মানবতার পূজারী। সেকুলারিজম ধর্মনিরপেক্ষতা অসাম্প্রদায়িকতার আড়ালেও অনেকেই সাম্প্রদায়িক অজগরের মত শক্তি সঞ্চয় করে।গিলে খাবে ক্ষমতা পেলেই।এই সভ্যতা এই সংস্কৃতি কিছুই ভালো লাগছে না ;অস্থিরতা। কাশ্মীর নিয়ে তথ্য চিত্র দেখতে ঢুকলাম গোলা গুলি রক্ত মৃতদেহের সাইনবোর্ড প্রদর্শন করে বলা হচ্ছে মানুষের আজাদির কাহিনী।মানুষ.....হায়রে মানুষ তোমার আজাদি কোনদিন হবে না।সাধারণ মানুষ একটা কৌশলের শিকার হচ্ছে; হয়েছে।
-এ আজাদি ঝুটা হ্যাঁয়।
তোমরা যে দিকেই যাও না কেনও গোলাম।
সাহেব,বিবি হতে পারবে না। ভারতের জনসংখ্যা পাকিস্তানের পাঁচ গুণ বেশি তবে মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় সমান।