উন্মেষ
ফৌজিয়া সিরাজ
মাত্র চারটি চরিত্র। ডক্টর রাজীব সেন (রিটায়ার্ড প্রফেসর অফ কলকাতা ইউনিভার্সিটি) চন্দ্রমল্লিকা ওরফে মলি ডক্টর সেনের স্ত্রী। ডক্টর চন্দ্রজিৎ সেন ওদের একমাত্র সন্তান
কমলা বাড়ির বহুদিনের সহযোগী।
উচ্চ মধ্যবিত্ত একটি পরিবার। পর্দা উঠলে দেখা যায় মল্লিকা অর্থাৎ মলি ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে একটা একটা করে তার সাজ সজ্জার গয়নাগাটি খুলছে। মাথায় জড়ানো জুঁই ফুলের মালাটি সযত্নে হেয়ার ক্লিপ সমেত খুলে ফেলে একটু গন্ধ শুঁকে নিয়ে পাশে রেখে দেয় অতি সাবধানে যাতে ছিঁড়ে না যায়। এরই মাঝে সে গুন গুন করে গেয়ে ওঠে "কে আবার
বাজায় বাঁশি এ ভাঙা কুঞ্জ বনে"। হঠাৎ রাজিব ব্যস্ততার সঙ্গে ঘরে ঢুকে পড়ে। মল্লিকা চমকে তাকিয়ে গান থামায়।
ডক্টর রাজীব সেন : কী হলো মল্লিকা থামলে কেন? সত্যিই গানটা যে তুমি কেন ছাড়লে বুঝিনা।
মল্লিকা- তাই নাকি?
রাজীব : জানাে মলি,আজ পার্টিতে তোমায় এত সুন্দর লাগছিল না কী বলবো...। আর দশ জনের ঈর্ষার কারণ হয়েছিল তুমি।
মল্লিকা : বল কী, এই বয়সেও মানে এই গোধূলি বেলায়?
(খিল খিল করে হেসে ওঠে)
রাজীব : কেন সৌন্দর্যের আবার বয়স আছে নাকি। ধাপে ধাপে সৌন্দর্যের রূপ এক এক রকম হয়ে ফুটে ওঠে।
মল্লিকা : ডক্টর রাজীব সেন, সাহিত্যের সঙ্গে তোমার বসবাস ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে জানি সেই ইউনিভার্সিটি থেকে...। তা বলে এই রাত সাড়ে দশটায় সাহিত্যের রসবোধ.... শুনতে অবশ্য ভালোই লাগছে। বলো, যত খুশি বলে যাও। আমিও তোমার সেই পুরনো ছাত্রীর মত মন দিয়ে শুনি....!
রাজীব : তা তো বলবেই, বুড়ো হয়ে যাচ্ছি কিনা? প্রফেসর ভৌমিক যখন তোমার গানের শেষে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠল তখন খুব ভালো লাগছিল, তাই না মলি? পার্টিতে সারাক্ষণই বুড়ো চোখ দিয়ে তোমায় গিলে খাচ্ছিল। ইচ্ছে করছিল মুখ থেকে চুরুটটা টেনে ফেলে দিই রবি ঠাকুরের 'ক্যামেলিয়া'র হিরোর মতো। ওর ওই মেয়ে দোষটা আর গেল না।
মলি : কেন, তোমার হিংসে হচ্ছিল নাকি? আর তাই ফিরে এসে এত রাতে আমার গুণগান শুরু করলে স্যার? (আবার হেসে ওঠে...) যাক্ এখনো এই বয়সে তুমি যে হিংসে করো সেটা ভেবে বেশ মজা লাগছে ।
রাজিব : না না ঠাট্টা নয়, সত্যিই তাই। ওর সুন্দরী একটা বউ পাশে থাকলেও, ও দশটা মেয়ের মধ্যে পূর্ণতা খুঁজে বেড়ায়।এটাই ওর রোগ। নেহাত আজ ওদের বিবাহ বার্ষিকী ছিল তাই কিছু বললাম না
মল্লিকা : সে তো সব পুরুষ মানুষই কম বেশি একই চরিত্রের।
রাজীব : (রাজীব মাথা নেড়ে) আমি মোটেও সেই পর্যায়ে পড়ি না। আমার সম্ভ্রমে বাধে। থাক ছাড়ো ওসব কথা। তোমার সাথে তো আর তর্ক করে পেরে উঠবো না ।
মল্লিকা : (চেঁচিয়ে ডাকে) কমলা দি ও কমলা দি......
কমলা : (ছুটে আসে) কী হলো বৌদিমণি, ডাকছ কেন?
মল্লিকা : (রাগত স্বরে বলে) বলি এঘরে একটা জলের বোতল রাখবে তো? কখন থেকে তেষ্টা পেয়েছে, গলা শুকিয়ে কাঠ। তার ওপর আবার সেই একঘেঁয়ে তর্ক আর তর্ক..... ।
কমলা : (মুহূর্তের মধ্যে বোতল নিয়ে আসে) এই নাও বৌদিমণি। আগে গলাটা ভেজাও তারপরে কথা বোলো। আর হ্যাঁ তোমরা তো আর রাত্রে কিছু খাবে না মনে হয়? একটু নলেন গুড়ের পায়েস আছে খাবে?
মল্লিকা : ( সোৎসাহে বলে ওঠে) পায়েস? হঠাৎ পায়েস করলে যে! আজ কারো জন্মদিন টন্মদিন কিছু আছে নাকি?
কমলা : কেন বৌদিমণি জন্মদিন না থাকলে বুঝি পায়েস করতে নেই? আমি চললাম, ইচ্ছে হলে খাবার টেবিলে চলে এসো।
(কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ হয়ে যায়। মল্লিকা এদিক ওদিক কী যেন খুঁজে বেড়ায় তার সন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে)
রাজীব : কী হলো মলি, হঠাৎ চুপ হয়ে গেলে যে? কী খুঁজে বেড়াচ্ছ চারিদিকে? যাও, হাত মুখ ধুয়ে নাও। বড্ড টায়ার্ড দেখাচ্ছে তোমাকে।
মল্লিকা : (সন্দেহের স্বরে বলে) আচ্ছা একটা জিনিস লক্ষ্য করেছ? কেমন একটা মিষ্টি পারফিউমের গন্ধ? ঠিক যেমন জিৎ-এর গা থেকে পেতাম। মাঝে মাঝে সুগন্ধ ভেসে আসছে। আমি পাচ্ছি,তুমি পাচ্ছ না? ভালো লাগছে না..... ওর কথা আজ বড্ড বেশি মনে পড়ছে কেন জানিনা। আচ্ছা ওদের আসতে তো এখনো বছর খানেক বাকি তাই না? তাহলে?
রাজীব : কী তাহলে? আরে বাবা মায়ের মন, এমনটা তো হতেই পারে। সবচেয়ে বড় কথা, তোমার জেদের বশেই কিন্তু জিৎকে বিদেশে পাঠাতে হলো!
মল্লিকা : কেন, তোমার ইচ্ছে ছিল না?
রাজীব : না,একেবারেই না। শুধু তোমার মুখের দিকে চেয়ে আমায় রাজি হতে হয়েছে। অমন মেধাবী ছেলে! ওরকম একটা ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করল শুধু কি ওই বিদেশের ইউনিভার্সিটিতে পড়াবে বলে? কেন, এখানে ভালো চাকরি জুটতো না?
মল্লিকা : আচ্ছা, সব দোষ আমার ঘাড়ে চাপাচ্ছ কেন বলতো? একসময় তুমি আমার শিক্ষক ছিলে-- অন্তত সেই অধিকার নিয়ে আমায় বোঝাতে পারতে? বলো, পারতে না?
রাজীব : কী করে বোঝাতাম বলো। তোমার কলিগদের ছেলেমেয়েরা বেশিরভাগই নাকি বাইরে চলে গেছে। ওরা বাবা মাকে দেখতে এলে মুঠো মুঠো চকলেট আনে। আরো কত রকমের পারফিউম তোমাদের গিফট করে। তোমাদের তখন আনন্দ ধরে না। অতএব জিৎ-এর পিছনে পড়ে রইলে, তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাকে কানাডায় পাঠানোর জন্য।
মল্লিকা : সবটাই কি আমার দোষ? বলো জিৎ-এর ইচ্ছে না থাকলে কি সম্ভব হতো? অযথা আমাকে দোষারোপ করছো কেন বলতো?
কমলা : (ছুটে আসে) উঃ আবার শুরু করলে তোমরা?
মল্লিকা : আহ্ কমলাদি, তুমি সব সময় আমাদের মাঝখানে আসো কেন বলতো? যাও নিজের ঘরে যাও।
রাজীব : (একটু গলা চড়িয়ে বলে ওঠে) ছিঃ মলি, কমলা দিকে ওভাবে কথা বলো না। ও এবাড়ির পুরনো সদস্য। সেই মায়ের আমল থেকে এবাড়িতে আছে। তাই এই পরিবারে ওর অধিকারও কম না। তোমাকে এবাড়িতে বউ হয়ে আসতে দেখেছে। শুধু তাই নয়, জিৎকে কীভাবে মানুষ করেছে বলো তো! ওর কাছে আমরা যথেষ্ট ঋণী....।
কমলা : ছাড়ো তো ওসব কথা! ও তো বৌদিমণি তোমার ওপর রাগ করে আমায় বকেছে। আমি কি বুঝি না? শোনো, অনেক রাত হয়েছে এবার ঘুমাতে যাও (বলতে বলতে চলে যায়)
মল্লিকা : (হঠাৎ মল্লিকা ডাক দেয়) কমলাদি একটু শোনো। দরজার ওপাশটায় একটু যাও.... কিছু গন্ধ পাচ্ছ? মাঝে মাঝে একটা মিষ্টি গন্ধ পারফিউমের পাচ্ছ, পাচ্ছ বল না? মানে ঠিক জিৎ-এর গায়ের গন্ধ?
কমলা: কৈ, নাতো বৌদিমণি। ও তোমার মনের ভুল....। আসলে ওকে তোমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। এক মুহূর্ত ওকে ছেড়ে তো কখনো থাকোনি। অথচ এই তিন বছর কেমন দিব্যি আছো। সময় সব ভুলিয়ে দেয়। এত রাতে আর বাবুয়ার কথা নাই বা ভাবলে ।কাটাও এভাবে সারা জীবন। মাঝে মাঝে তোমরা যাবে আবার ওরা দু তিন বছর পর আসবে..... এভাবেই চলবে... আর কি....( বিড়বিড় করতে করতে চলে যায়)
মল্লিকা : সত্যি, সবাই মিলে এমন করছ যেন জিৎ-এর বাইরে যাওয়ার জন্য আমিই দায়ী। একেবারে ভিলেন বানিয়ে দিলে বাড়ি শুদ্ধ সবাই..... আচ্ছা ও নিজেও তো না বলতে পারতো....
চন্দ্রজিৎ: (হঠাৎ হাততালি দিতে দিতে জিৎ-এর প্রবেশ) বাহ্ চমৎকার জমেছে তোমাদের এই পক্ষ-বিপক্ষের লড়াই।আচ্ছা মা, তুমি কি সে সুযোগ আমায় দিয়েছিলে? ছোট্ট থেকে তো তোমার শাসনেই বড় হয়েছি অবশ্যই আমার মঙ্গলের জন্য কী বলো? কী হলো, কী দেখছ অবাক হয়ে?
মল্লিকা : তুই? কখন এলি? কোথায় ছিলি এতক্ষণ? স্নিগ্ধা, সে কোথায়? আ-আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। (বলতে বলতে কেঁদে ফেলে)
চন্দ্রজিৎ : (মাকে জড়িয়ে ধরে) আরে কী হলো, কাঁদছ কেন? এইতো তোমার সামনে আমি সশরীরে দাঁড়িয়ে আছি মাগো....।
মল্লিকা : দেখলে দেখলে তোমরা আমি ঠিক বলেছি কিনা?আরে বাবা আমি মা! আমি ওর গন্ধ পাব না?
চন্দ্রজিৎ : কখন থেকে আমি পাশের ঘরে বসে বসে তোমাদের সব কথা শুনছি। শুধু এন্ট্রি নিতে পারছিলাম না। দেখলাম, না আর না। এবার চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যাচ্ছে কলহ। শেষ পর্যন্ত মঞ্চে আমায় অবতরণ করতেই হলো।
মল্লিকা: কখন, কখন এলি, হঠাৎ করে.... স্নিগ্ধা কোথায়? কিছুই তো বুঝতে পারছি না।
জিৎ : আরে বাবা একটু থেমে থেমে বলবে তো? কোনটার জবাব আগে দেব আমিও বুঝতে পারছি না।
মল্লিকা : (অভিমান করে বলে) কমলাদি, তোর বাবা সবাই নিশ্চয়ই জানতো... শুধু আমাকেই কিছু জানাসনি।
জিৎ : সারপ্রাইজ দেবো বলে। এবার বুঝলে?
মল্লিকা: খুব বুঝেছি। আমাকে বাদ দিয়ে তোদের প্ল্যান প্রোগ্রাম বেশ ভালই হয়। আমি কেউ না?
জিৎ: মা, তুমি আবার ভুল করছ। এই বাড়িতে যা কিছু হয় বা এতদিন ধরে যা হয়ে এসেছে প্ল্যান প্রোগ্রাম সবই তো তোমার মত অনুযায়ী। তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তো কখনো কিছু হয়নি। তাহলে সবটাই শোনো, আমি আবার এই দেশে ফিরে আসছি মা। ওখানে একটা দমবন্ধ জীবন, সবই কৃত্রিম। নিজের রক্তের মানুষ বলতে কেউ নেই, একটা মেকী জীবনযাপন। তার সঙ্গে আছে চরম ব্যস্ততা। ওই যান্ত্রিক পরিস্থিতি কতদিন ভালো লাগতে পারে বলো? অন্তত: আমার তো লাগেনা। মানসিক দিক দিয়ে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি মা। তাই এই সিদ্ধান্ত। কি ঠিক করিনি?
মল্লিকা : ( উচ্ছ্বসিত হয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে) সত্যি সত্যি বাবাই তুই আবার আমার কাছে ফিরে আসবি?
জিৎ: হ্যাঁ মা। তবে তোমার আঁচলের তলায় বাধ্য ছেলের মত মোটেই নয়। ফিরে আসবো আমার এই দেশে। জানো মা, বাবা তোমাকে নিয়ে সত্যিই খুব চিন্তায় ছিল। এমনকি কমলা পিসিও। কেন জানো?
ভয়, সংসারটা ভেঙে যাওয়ার ভয়। এটাতো একটা সর্বগ্রাসী ভাঙনের যুগ মা। হাই টেকনোলজির যুগ..যুক্ত থাকতে থাকতে বিযুক্ত হয়ে যাওয়ার যুগ। পরবর্তী প্রজন্মের কথা একবার ভেবে দেখেছ কি? আর সেই কারণেই স্নিগ্ধাকে নিয়ে চলে আসতে চাইছি।
মল্লিকা: তার মানে স্নিগ্ধা....!
শুভজিৎ: হ্যাঁ মা, এখন First trimester ডাক্তার মাস দুয়েক রেস্ট নিতে বলেছেন। তাইতো তোমাদের সঙ্গে নিয়ে যাবো ফিরে আসবো একসঙ্গে সবাই। বাবা তোমাকে এখনো জানাইনি আমি যাদবপুর ইউনিভার্সিটির একটা ভালো offer পেয়েছি। স্বাচ্ছন্দ্য চাই না, ঐশ্বর্য্য, বৈভব কিচ্ছু না, কিচ্ছু না...... শুধু চাই আমার সন্তানের মধ্যে গ্রোথিত হোক বাংলা মাটির সোঁদা গন্ধ।
মল্লিকা : বাহ্ কী সুন্দর বলছিস তুই সোনা!
জিৎ : শোনো মা, ইংরেজি ভাষাটাকে first preference অবশ্যই দিতে হবে নিজের কাজের জন্য। বিদেশে পড়াশোনাও করতে হবে। কিন্তু ফিরে আসতে হবে নিজের মাতৃক্রোড়ে। এখনকার প্রজন্ম মানে আমরা বড্ড স্বার্থপর হয়ে গেছি। নিজের স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভেবে তোমাদের কথা না শুনে জোর করে চলে গেছি বিদেশে কিছুটা কৌতূহল বশেও।
মল্লিকা: ঠিক, ঠিক এক্কেবারে ঠিক কথা।
জিৎ: আচ্ছা বাবা, তুমি তো বাইরে ভালো ভালো অফার পেয়েছিলে। সিনিয়র ক্যামব্রিজের টপ গ্রেডে ছিলে। কিন্তু কখনো ওখানে বসবাসের কথা ভাবোনি। কেন, কেন বলতে পারো? এসব কথা তো তোমার মুখে শুনেছি। মা যখন গত বছর হসপিটালে এডমিটেড ছিল আমি তো আসার সুযোগই পেলাম না। কত বড় দুশ্চিন্তায় ছিলাম বলো তো?
আর দাদু? যার আঙুল ধরে ছোটবেলায় স্কুলে যেতাম, আমার সব বায়না তো দাদুই মেটাতো। তারপর একদিন খবর এলো সব শূন্য ........। সেই সব সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো যদি অনুভূত না হয় তাহলে আর কীসের শিক্ষা।
কমলা : ঠিক ঠিক , কথাগুলো তুমি ঠিক বলছো বাবুয়া।
জিৎ: বাবা, অনুপকে তোমার মনে আছে? আমার থেকে দু'বছরের সিনিয়র ছিল। ও তো আমার অনেক আগেই ক্যানাডাতে চলে গেছে। গত বছর ওর বাবা মানে কাকু ক্যান্সারে মারা যাওয়ার প্রায় পাঁচ দিন পর এসে ও ছুটে গেল পিস হেভেনে। সেই শেষ দেখা ওর বাবার সঙ্গে। ফিরে গিয়ে ও খুবই ডিপ্রেশনে ভুগছিল। বলো এটা কি একটা জীবন? তোমরা আমায় যেমন তিল তিল করে বড় করে তুলেছো, তেমনি আমারও তো ইচ্ছে করে তোমরা কীভাবে তিলে তিলে বুড়ো হচ্ছ দেখতে?
এখন তোমরাই বলো মা, আমি ঠিক decision নিয়েছি কিনা?
কমলা : চলে এসো বাবুয়া। আর ওখানে থেকো না। তোমাকে ছোটবেলায় আমি কত গল্প শোনাতাম। ঘুরে ঘুরে খাওয়াতাম....। তোমার সন্তানেরে তেমন করবো না? সেই যে তোমায় গান শোনাতাম " আয় হাঁস আয় আয় চৈ চৈ......." আর তুমি খিলখিল করে হাসতে। দাঁত উঠলো আবার পড়েও গেল। তখন তোমার হাসিটা যে কী সুন্দর লাগতো বাবুয়া, এখনো চোখ বন্ধ করলে সব দেখতে পাই। যাই, অনেক কাজ আছে.... রান্নাঘরটা গুছিয়ে ফেলি (গুন গুন করে গাইতে গাইতে চলে যায়)
মল্লিকা: হ্যাঁ যাও। উফ্ একবার কথা বলতে শুরু করলে কমলাদিকে আর থামানো যায় না। বহুদিন পর ওর গোমড়া মুখে হাসি দেখলাম। (স্বামীর দিকে বিহ্বলভাবে তাকিয়ে বলে) হ্যাঁ গো, জিৎ যা করতে চলেছে.... ভবিষ্যতের স্বপ্ন ..... সত্যিই কি ও ঠিক ডিসিশন নিচ্ছে? কোথাও তোমার কোনো ভুল মনে হচ্ছে নাতো?
রাজীব : না মলি, কোনো ভুল সিদ্ধান্ত জিৎ নেয়নি। তুমিই বলোনা, এই তিন বছর তুমি কি খুব শান্তিতে ছিলে? যে তুমি কখনো রাগতে না সব সময় হাসি খুশি থাকতে, সে কেমন পাল্টে গেল এই তিন বছরে কেন জানো? কেন, আমাদের দূরত্ব ক্রমশ বেড়েই চলেছিল ?কেন ? শুধু জিৎ-এর শূন্যতা। তোমার মন ভেতর থেকে কখনো মেনে নিতে পারেনি। শুধু হেরে যাবে বলে আমার কাছে প্রকাশ করতে না আর তাই সবসময় খিটখিট করতে করতে অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলে আমায় ছেড়ে চলে যাবে। কি তাই তো ?
মল্লিকা : ( কেঁদে ফেলে) ব্যাস আর না। চুপ কর চুপ কর প্লিজ। আমি আমার ভুল মেনে নিচ্ছি। কিন্তু......
জিৎ: কীসের "কিন্তু" মা?
মল্লিকা: কিছু না, ও অন্য কথা। তোমার বাবার সাথে আমার....…।
জিৎ:( রসিকতা করে বলে) ও... আমায় সে বিষয়ে থাকতে নেই তাইতো?( বলেই হেসে ওঠে) মা তুমি এখনো ইমম্যাচিউর আছো ।কেন জানো?
মল্লিকা: কেন?
ইন্দ্রজিৎ: ঐ যে ইউনিভার্সিটিতে বাবার বাধ্য ছাত্রী ছিলে তাই, এখনো বাবাকে ভয় করে চলো .......
রাজীব: ভয়? তোর মা আমাকে ভয় পায়?( হা- হা -হা) কে কাকে ভয় করে চলে একবার কমলাদিকে জিজ্ঞেস করে দেখিস ?
জিৎ: (মা'র সঙ্গে একটু মজা করে) আচ্ছা মা তোমার রোল নাম্বার যেন কত ছিল? সেভেনটিন তাইতো ?এখনো কি বাবা তোমাকে ঐভাবেই ডাকে না নাম ধরে ?
মল্লিকা : বাবা, এখনো কোনো সিরিয়াস কথা থাকলে ঐভাবেই হাঁক পাড়েন রোল নং সেভেনটিন'...... (হাসতে থাকে সবাই)
জিৎ: বেশ রোমান্টিক ছিলে তোমরা, কি বলো? মা তোমাদের ক্লাসের মেয়েরা জানতো?
মল্লিকা : কিছুটা তো আন্দাজ করতো। তারপর বিয়ের নেমন্তন্ন কার্ড দেখে আর কিছুই গোপন রইল না।
রাজীব:(সলজ্জে বলে ওঠে) থাক খুব হয়েছে। এই রাত দুপুরে আর ঐ সব গল্প ছেলেকে শোনাতে হবে না।
কমলা : (কমলা ভেতর থেকে হাঁক দেয়) কী হলো এসো তোমরা খাবার টেবিলে। বাবুয়ার খিদে পেয়েছে তো নাকি?
মল্লিকা : সে কি, তুই এখনো ডিনার করিস নি? বলবি তো,। নে চল চল চল....
রাজীব : কমলা দি এদিকে একবার এসো। তোমার সঙ্গে জরুরী কথা আছে।
কমলা : কী আবার জরুরী কথা?
রাজীব : বলছি, আমরা বাবুয়ার সঙ্গে চলে যাওয়ার পর তুমি কিন্তু দেশ থেকে একবার ঘুরে এসো কেমন?
কমলা: বারে! আমাকে চলে যেতে বলছো?
জিৎ : নারে বাবা না, সেই কবে তোমার মেয়ের বিয়েতে গেছিলে। বাপ মরা মেয়েটাকে একবার দেখে আসবেনা? সারা জীবন তো এ বাড়ির সবকিছু তুমিই সামলালে। নাতিবাবু কত বড়টি হয়েছে দেখবে না? আমরা যখন মাসখানেক পরে স্নিগ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসবো তার আগেই তুমি চলে আসবে। বাড়ির চাবি তো তোমার কাছেই থাকবে। ঘরদোর সব গুছিয়ে রাখবে। কি এবার খুশি তো! সংসার থেকে একেবারে সরে থেকো না। যোগাযোগ না রাখলে সম্পর্কে চিড় ধরবে যে?
কমলা : (কান্না চেপে রেখে হেসে ফেলে) বুঝেছি বুঝেছি, আর বলতে হবেনি। এবার চলো তো রাত অনেক হলো।
মল্লিকা: চলো সবাই..... এসো...
রাজীব: রোল নং সেভেনটিন.....
মল্লিকা: (চমকে ওঠে) আবার কী হলো?
রাজীব: কেও যেও না। দাঁড়াও এখানে।
মলি, আমার আলমারির ড্রয়ারে একটা ব্রাউন কালারের খাম আছে ওটা নিয়ে এসো। (মলি বাধ্য মেয়ের মত খামটা এনে রাজিবের হাতে দেয়)।
রাজীব : উহু, ওটা তুমিই খোলো। ভিতরে একটা কাগজ আছে বার করো।
জিৎ : (অবাক হয়ে বলে) কীসের কাগজ?
রাজীব: তোমার মা, আমাকে ডিভোর্সের ফর্ম ফিলাপ করে জমা দিতে দিয়েছিলেন।
জিৎ: কী বলছ, এতদূর...?
মল্লিকা: (সবিস্ময়ে) তুমি ওটা জমা দাওনি? থ্যাংক গড। এদিকে সেই দুশ্চিন্তায় আমার তো ঘুম হতো না।
রাজীব: আমি কি তোমার মত পাগল নাকি? কত কষ্ট করে তোমার বাবার কাছ থেকে তোমায় চেয়ে এনেছি..... হাঃ হাঃ হাঃ
(সবাই একসঙ্গে হেসে ওঠে)। নাও, এবার ছিঁড়ে ফেলো সবার সামনে। ওরা সাক্ষী থাকুক......
হাসিতে ফেটে পড়ে সবাই ।
(নেপথ্যে ভেসে আসে-- কেন এই নিঠুর খেলা খেলিলে আমার সনে...…)