সহমরণে মাদ্রী   

 বিজয়লক্ষ্মী মুখার্জী 

                                                                  ১


 অসংলগ্ন পদক্ষেপে  দেবী মাদ্রী  একাকিনী প্রবেশ করলেন কুটির প্রাঙ্গণে। আসেপাশের কুটির থেকে ঋষিপত্নীরা বেরিয়ে এসেছেন, অবাক দৃষ্টিতে দেখছেন মাদ্রীকে।  তাঁর মাটিতে লুটোনো আঁচল,অসংবদ্ধ কেশভার ,শূন্য  দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছে মূল্যবান কোনও সম্পদ হারিয়ে ফেলেছেন। মাদ্রীকে দেখে ছুটে আসছিলো ক্রীড়ারত নকুল ও অর্জুন, কিন্তু সদা হাস্যমুখী , চঞ্চলা জননীর নির্বাক দৃষ্টি তাদের থমকে দিয়েছে। পাঠে ব্যপৃত যুধিষ্ঠির  তাকিয়ে আছেন অবাক হয়ে , মধ্যম পান্ডব  ভীম বেরিয়ে এলেন পাকশালা থেকে, তিনি মাতা কুন্তীকে  রন্ধনকার্যে  সাহায্য করছিলেন। কাঠের পুতুলের মত নিষ্প্রাণ মাদ্রীকে দেখে কুন্তীর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল  এক অজানা আশঙ্কায় । বিস্মিত কুন্তী দেবী এগিয়ে এলেন, তাঁর অঞ্চল ধরে কনিষ্ঠ সহদেব। সহসা দেবী কুন্তীর পা থমকে গেল, দৃষ্টি পড়লো তপোবন থেকে আগত ঋষিকুমারদের  প্রতি । তাঁদের কাঁধে  হস্তিনাপুর নরেশ পান্ডুর নিষ্প্রাণ দেহ,তাঁরা সযত্নে দেহটি প্রাঙ্গণের একধারে নামিয়ে রেখে নত মস্তকে দাঁড়ালেন । থেমে গেল পাখিদের কাকলি, নির্জন  পরিবেশ আরও নিস্তব্ধ হল। আকাশে বাতাসে  রণিত হতে থাকলো  মহারাজ পান্ডু আর নেই। শুধু মাদ্রীই যেন সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজের কুটিরে প্রবেশ করলেন, দেবী কুন্তী এবং পুত্রদের দৃষ্টি তাঁকে অনুসরণ করলো । মহারাজ পান্ডুর প্রেয়সী  মাদ্রীর  এখনও যেন হৃদয়ংগম হচ্ছেনা,কয়েক মুহুর্তের বিস্মৃতিতে  কি অঘটন ঘটে গেছে! হঠাৎই যেন চেতনা ফিরলো তাঁর। না,না বিস্মৃতি নয়,এ যে অসংযম। অনুতাপের জ্বালায় জ্বলতে লাগলেন  মাদ্রী, তিনি  আর পান্ডু দুজনেই তো জানতেন এই অসংযমের ভবিতব্য কি হতে পারে! তাহলে কি এটাই নিয়তি ছিল! কুটীর মধ্যে একাকিনী মাদ্রী, চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে গন্ডদেশ, বক্ষাঞ্চল । কেটে যাচ্ছে সময়। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন মাদ্রী, মনে মনে বললেন, 


“ হা ঈশ্বর! মহারাজের সাথে যদি আমাকেও আপনি তুলে নিতেন। এই পোড়ামুখ যে কাউকে দেখানোর নয় “। 


কুন্তী প্রবেশ করলেন কুটীরে, দরজা খোলার শব্দে আনত মুখ তুলে মাদ্রী জলভরা চোখে তাকালেন সপত্নী কুন্তীর দিকে, না, কোনো আশ্রয় নেই সেখানেও , চোখ নামিয়ে নিলেন মাদ্রী। কুন্তীর স্তম্ভিত বেদনার্ত গম্ভীর মুখ ক্রোধে রক্তিম, চোখে অবিশ্বাস, ঘৃণাও কি!   


 " ছিঃ মাদ্রী, ছিঃ! এটা তুই  কি করে ঘটাতে পারলি ছোটো? তুই তো জানতিস আর্যপুত্রর ওপর অভিশাপের কথা! তাহলে কি করে! তাই ভাবি আরণ্যক জীবনে এতো সজ্জা? এতো প্রসাধন  ?  নিশ্চয়ই তুইই  মহারাজকে প্ররোচিত  করেছিলি "! 


কুটির প্রাঙ্গণে ভীড় বাড়ছে,  মাদ্রীর দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ  গলা নামালেন ক্ষুব্ধ কুন্তী , 


"  মহারাজের সাথে বনভূমিতে একাকী যাওয়ার কি খুব প্রয়োজন ছিল? একজন পুত্রও সাথে থাকলে তো  মহারাজের সংযম ভঙ্গ হতোনা , এই অঘটনও ঘটতো না "! 

                                                     ২

আরও কতকিছু বলে যাচ্ছেন কুন্তী। কিন্তু না, আজ আর রাগ ক্ষোভ কোনো অনুভূতিই কাজ করছে না মাদ্রীর মধ্যে। কোনো উত্তর দিতেও মন চাইছে না।   কি বলবেন তিনি কুন্তীকে? তিনি কি স্মরণ করিয়ে দেবেন, নকুল সহদেবকে কুন্তীই যেতে দেননি। তর্কে পারঙ্গম নন কোনোদিনই , আজও পারলেন না মাদ্রী। দেবী  কুন্তীরও যে তাঁর মতই স্বামীবিয়োগ ঘটেছে  আজ!  স্বামীসমাগমের বেদনামধুর স্মৃতিতে  মাদ্রীর হৃদয় পূর্ণ  কিন্তু  পাটরাণী হয়েও কুন্তীর প্রাপ্তির ভাঁড়ার শূন্য। হায়, যদি   কুন্তীর দৃষ্টির সামনে আর না দাঁড়াতে হতো। যদি আরও গভীর অরণ্যে  মুখ লুকোতে পারতেন। কিন্তু নাবালক পুত্রদের নিয়ে কোথায় যাবেন তিনি?   ওরা যে  হস্তিনাপুর নরেশ পান্ডুর পুত্র।  রাজকুমারদের ওপর মাদ্রীর থেকে অনেক বেশি অধিকার  হস্তিনাপুরের। তাছাড়া দুই পুত্রের কাছে ছোটো থেকেই মাদ্রীর প্রয়োজন কমই । নকুল  তো অগ্রজদেরই  ছায়া, আসে কোথায় মাদ্রীর কাছে ,আর সহদেবের আদর  আবদার সবই তো তার বড়োমা কুন্তীর কাছে।  কিন্তু তাদের ভবিষ্যতের চিন্তাই মাদ্রীকে ফিরিয়ে এনেছে এখানে। এটা বিবাদের সময় নয়, নীরবে কুন্তীর কথাগুলো হজম করতে লাগলেন মাদ্রী। 

                                                            ৩

কুন্তীর চোখে জল, কিন্তু হৃদয় জ্বলছে রাগে, ঈর্ষার আগুনে ,  মনে অপমানের জ্বালা। প্রথমা রাণী তিনি পান্ডুর । তাঁর মন্ত্রোচ্চারণে দেবতারা আকৃষ্ট হন কিন্তু  স্বামীর হৃদয় আকর্ষণের খেলায় বয়সে ছোটো এই  সপত্নীটির কাছে বারবার পরাজিত হয়েছেন তিনি। স্বামীর প্রেম কি করে পেতে হয়, স্বামীকে কি করে নিজের দিকে আকর্ষণ করতে হয় এসব কলা সুন্দরী সুতনুকা মদ্ররাজকন্যা ভালোই জানেন। যাদবকন্যা পৃথা, পিতৃবন্ধু  কুন্তীভোজের পালিতা কন্যা কুন্তী নানা  বিপ্রতীপ পরিস্থিতির  মধ্যে বেড়ে উঠেছেন, মনের তুলনায় বুদ্ধিকে সর্বদা দু’কদম এগিয়ে রাখেন তিনি। কন্যাবস্থায়  প্রথম সন্তানটিকে জলে ভাসিয়ে দেওয়ার সময়ে মগজের কথাই  শুনেছিলেন তিনি। হস্তিনাপুর নরেশ পান্ডুকে স্বয়ম্বরে বরণ করার সময়েও কুন্তী মাথা দিয়েই হিসেব করেছিলেন। কিন্তু নববধূ হয়ে হস্তিনাপুর প্রাসাদে প্রবেশ করে  স্বামীকে নিজের করে পাওয়ার আগেই  পিতামহ ভীষ্মের নির্দেশে মদ্রকুমারীকে  সপত্নীরূপে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। রাজপ্রাসাদের দেওয়াল কবেই বা  রমণীর মনের মূল্য দিয়েছে! হস্তিনাপুর নরেশ পান্ডু কোনো বিশেষ আলোচনার  প্রয়োজনে যদিবা বুদ্ধিমতী কুন্তীকে স্মরণ করতেন, স্বামী পান্ডুর মনোরাজ্যে ছিল মাদ্রীর একান্ত বিচরণ। রমণীত্বের এই  পরাজয় কুন্তীকে বিষণ্ণ, ক্ষুব্ধ করে তুলত, বরং এই তপোবনের নিরালায় এসে তিন দেবাশীষধন্য  পুত্রের গর্বিতা মা হয়ে তিনি স্বামীকে কিছুটা অধিকারে পেয়েছিলেন। কুন্তী অবাক হচ্ছিলেন, তাঁর কটুক্তিতে মাদ্রী আজ আহত হচ্ছেন না। মনকে শক্ত করে কুন্তী কুটীরের বাইরে এসে দাঁড়ালেন । তাঁর এখন অনেক কাজ, হস্তিনাপুরে খবর পাঠানো হয়েছে কিনা দেখতে হবে,  সিংহাসনে পুত্রদের  উত্তরাধিকারের দাবি প্রতিষ্ঠা করতে হবে সকলের কাছে



 প্রাঙ্গণের একপ্রান্তে  মহারাজ পান্ডুর নিষ্প্রাণ দেহ শয়ান , কিন্তু মুখে এখনও তৃপ্তির ছাপ! কিসের তৃপ্তি মহারাজ! প্রিয়া সঙ্গমের? না, এখন অভিমান করার সময় নয়। কুন্তী দৃষ্টি সরিয়ে  নিলেন।  বিষণ্ণমুখে  বসে আছে পুত্ররা   । যুধিষ্ঠির পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে নিঃশব্দ , অস্থির মধ্যম পান্ডব  পদচারণা করছেন , আর নকুল সহদেব তো পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করতেই অক্ষম ! তৃতীয় পান্ডব অর্জুন  দুই অনুজকে জড়িয়ে  বসে আছেন একধারে । প্রাঙ্গনে একে একে ঋষি, ঋষিপত্নীরা জমা হচ্ছেন, তাঁদের  ফিসফিস  ক্রমশঃ গুঞ্জনের রূপ নিচ্ছে। থামাতে হবে এই গুঞ্জন। হস্তিনাপুরে  এতক্ষণে এই মর্মান্তিক সংবাদ পৌঁছে গেছে, পিতামহ ভীষ্ম, মহামন্ত্রী  বিদুর ও অন্যান্যরা রওনা হয়েছেন। কিন্তু ওঁদের এসে পৌঁছতে এখনো কিছুটা সময় লাগবে। আচ্ছা জ্যেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্র কি খুশি হয়েছেন অনুজের মৃত্যুতে! দিদি গান্ধারী আজ মহারাণী! মনের মধ্যে নানান  চিন্তা , 


“ আমি একা এত দায়িত্ব কি করে সামলাবো আর্য পুত্র “? 


 বুক ফেটে কান্না আসছে তবুও এইমুহূর্তে  কুন্তী প্রাঙ্গণে উপস্থিত থাকাই  বেশি আবশ্যক মনে করলেন ।  মাদ্রীকে কুটীরে একাকিনী  রেখে দ্বার টেনে দিয়ে  স্বামীর দেহের দিকে অগ্রসর হলেন কুন্তী। সহদেব ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো কুন্তীকে। 



                               ৫


   মাটির দিকে দৃষ্টি থাকা সত্ত্বেও  মাদ্রী অনুভব করলেন কুন্তীর নির্গমন, ভালোই হয়েছে, এই নির্জনতাটুকু এখন তাঁর বড়ো দরকার। এতক্ষণ দেবী কুন্তীর  অনেক কটুবাক্য তিনি  শুনেছেন । হস্তিনাপুর  সংক্রান্ত আরোও  কি কি  যেন বলছিলেন দেবী কুন্তী , নিশ্চিত গুরুত্বপূর্ণ কিছুই; কিন্তু  মাদ্রী কোনোদিনই রাজ্য রাজনীতির জটিলতা বোঝেন না । অনুমান করতে পারছেন  পাটরাণী কুন্তী এই মুহূর্তে  পিতৃহীন পুত্রদের স্বার্থরক্ষায় ব্যাকুল। কিন্তু  মাদ্রী  এসব কিছু ভাবতে পারছেন না। হস্তিনাপুর প্রাসাদে পা রাখার মুহুর্ত থেকে তাঁকে কুন্তী ঈর্ষা করেছেন। স্বয়ম্বরে কুন্তী মহারাজ পান্ডুকে বরমাল্য পরিয়েছিলেন ,  সেই অধিকারে মহারাজকে নিজের অর্জিত বলেই মনে করতেন । আর সেখানে অসম্ভব রূপবতী  মাদ্রী পূর্ণ তরুণী হয়ে ওঠার আগেই  পিতামহ ভীষ্ম পৌঁছেছিলেন মদ্র রাজসভায় । হস্তিনাপুরের আত্মীয়তা কার কাম্য নয়, শল্যরাজের  সাদর সম্মতিতে, যথাবিহিত কন্যাপণ দিয়েই পান্ডুর জন্য  নিয়ে এসেছিলেন মাদ্রীকে , সেকারণেই বোধহয় কুন্তীর চোখে সর্বদা তাঁর জন্য তাচ্ছিল্য দেখতেন মাদ্রী ।  ভ্রাতা শল্যর আদরিণী , প্রজাপতির মতো নির্ভার  মাদ্রী বিবাহের পর কুন্তীর কথা অবগত হন। অস্বাভাবিক লাগেনি, রাজপুরুষেরা একাধিক বিবাহ তো করেই থাকেন, কখনো রাজ্য বাড়াতে আবার কখনো রাজ্য রক্ষা করতে, কিন্তু  তীক্ষ্ণধী ব্যক্তিত্বসম্পন্না  কুন্তীর সামনে  মাদ্রী কখনও  সহজ হতে পারেননি, নিজেকে ওনার সমকক্ষ  ভাবতেও  সাহস করেননি। যদিও মহারাজ পান্ডুর  আকর্ষণ ছিলো সুন্দরী মাদ্রীর প্রতি, আর এখানেই মাদ্রীর পত্নীসত্বার সার্থকতা।  কিন্তু সুখ কখনো চিরস্থায়ী হয়না, তাই  একবার  মৃগয়ায় গিয়ে মহারাজ পান্ডু, রমণে ব্যপৃত হরিণ রূপী ঋষি কিদম্বী ও তাঁর পত্নীর  মিলনের শীৎকারকে মৃগের আওয়াজ ভ্রমে শরবিদ্ধ করলে মৃত্যু পথযাত্রী ঋষি মহারাজকে অভিশাপ দেন,  

   " কামনাতুর হয়ে পত্নীসম্ভোগকালে  মহারাজ তোমার  মৃত্যু ঘটবে “!  

বিষয়টি  প্রথমে কুন্তী ও মাদ্রী দুজনেরই অজ্ঞাত ছিলো ।  কিন্তু বড়ো আত্মগ্লানি হয়েছিল, যখন  মহারাজ নিজের যন্ত্রণা প্রকাশ করতে  পাটরাণী কুন্তীর কাছেই প্রথম অকপট হলেন।  কুন্তীকে অনুরোধ করেছিলেন  ,

'' দেবী নিয়োগ প্রথায় সন্তান উৎপাদন শাস্ত্রসম্মত। হস্তিনাপুরের স্বার্থে তুমি কোনো শাস্ত্রজ্ঞ ও শস্ত্রজ্ঞ পুরুষের দ্বারা নিয়োজিত হও “। 


কুন্তী নিশ্চিন্ত করেছিলেন


 “মহারাজ,ঋষি দুর্বাসার বরে আমি  যেকোনো দেবতাকে আমন্ত্রণ জানাতে সক্ষম” । 


মহারাজ পুত্রলাভের কামনায়  দুই রাণী সহ এই  নিভৃত বাসে আসেন ।  যথাসময়ে  ধর্ম, পবন আর ইন্দ্রের  কৃপায় কুন্তীর গর্ভে তিন  পুত্র জন্মায়। 


পান্ডু  অপুত্রক হওয়ার গ্লানি থেকে মুক্ত হন।  একই সময়ে হস্তিনাপুরে দেবী গান্ধারীও  শতপুত্র ও এক কন্যার জন্ম দেন।   মাদ্রীর মনস্থিতি  তখন  বড়ো করুণ ,  বিনাদোষে  নিজেকে  অক্ষম মনে করছিলেন। সেই একবার মাদ্রী পান্ডুর ওপর প্রভাব খাটিয়ে ছিলেন, মহারাজের অনুরোধে দেবী কুন্তী মাদ্রীকে মন্ত্রটি  শেখালেও মাত্র একবারই  ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলেন , ভেবেছিলেন ভবিষ্যতে পুত্রদের  সংখ্যাধিক্যের জোরে নিজের ক্ষমতা বজায় রাখবেন । বেদনার মধ্যেও মাদ্রীর মুখে ম্লান হাসি , কুন্তী  সপত্নীকে বোকা ভেবে ভুল করেছিলেন। একটি  মন্ত্রে অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে‌ আমন্ত্রণ জানিয়ে  নকুল সহদেব কে লাভ করেন তিনি ।  কিন্তু তাতেই বা কি!  ম্লান হাসি ফুটে ওঠে মাদ্রীর চেহারায়। নকুল তার অগ্রজদের ছায়া বললেই হয়, আর  সহদেব  ,সে  তো জন্ম থেকে কুন্তীরই বেশি কাছের ।   আজ এই মুহূর্তে অবশ্য পুত্রদের নয়, মাদ্রীর চোখের সামনে ভাসছে মহারাজের  অন্তিম মুহূর্তের যন্ত্রণাকাতর মুখচ্ছবি , এক হাত রেখেছিলেন নিজের বক্ষে, অপর হাতটি বাড়িয়েছিলেন, না মাদ্রীকে নয়, আকুল দৃষ্টিতে কাদের  যেন খুঁজছিলেন । মাদ্রী জানেন, সেই মুহূর্তে পান্ডুর দৃষ্টি খুঁজে বেড়াচ্ছিলো পাটরাণী কুন্তী ও তাঁর  পুত্রদের, মাদ্রীর উপস্থিতি সেখানে  কোথায় । এক পলকে নিজেকে ব্যর্থ মনে হয়েছিল তাঁর ।  

                                                                      ৬

 দেবী কুন্তী তখন বোধহয় হস্তিনাপুরের কথা বলছিলেন, মাদ্রীর বিষণ্ণ হৃদয়ে সহসাই এই প্রথমবার রাজ্যের ভবিষ্যৎ  নিয়ে ভাবনা জাগলো। সিংহাসনের প্রকৃত অধিকারী গঙ্গাকুমার ভীষ্ম , চিরকুমার আজীবন  সিংহাসনের প্রহরী হয়েই রয়ে গেলেন।  দেবী সত্যবতীর প্রতি  মহারাজ শান্তনুর আকর্ষণ, দাসরাজার লোভ সেদিন  পিতৃভক্ত কুমারকে  বাধ্য করেছিল  চিরকৌমার্যের ব্রত নিতে । সত্যবতী ও মহারাজ শান্তনুর প্রথম সন্তানের যুদ্ধে মৃত্যু ঘটে  আর  দ্বিতীয় সন্তান মহারাজ বিচিত্রবীর্য  উদ্দাম বিলাসী জীবন কাটিয়ে অসময়ে নিঃসন্তান  মারা যান । ভরত বংশ ব্যাসদেবের আশীষধন্য । সত্যবতীর নির্দেশে ব্যাসদেবের কৃপায় দেবী অম্বিকা ও অম্বালিকার গর্ভে  ধৃতরাষ্ট্র ও পান্ডুর  জন্ম হয় ,আর হ্যাঁ এক দাসীর গর্ভে  কাকা বিদুরের । অগ্রজ ধৃতরাষ্ট্রর অন্ধত্বের কারণে সিংহাসনে বসেছিলেন মহারাজ পান্ডু । আজকে আবার হস্তিনাপুরের সিংহাসন রাজাহীন হয়ে পড়লো ।  মাদ্রী অনুমান করতে পারেন  অগ্রজ ধৃতরাষ্ট্র মনে মনে স্ফুরিত হচ্ছেন নিশ্চয়ই , কিন্ত ভরসা এই যে পান্ডু নন্দনদের স্বার্থ পিতামহ ভীষ্ম ও মহামতি বিদুর নিশ্চিত রক্ষা করবেন । তাছাড়া সপত্নী হলেও  মাদ্রী এইসব রাজনৈতিক জটিলতার ক্ষেত্রে, পঞ্চপুত্রের স্বার্থরক্ষার ক্ষেত্রে দেবী কুন্তীকেই  নিজের থেকেও বেশি ভরসা করেন তিনি। নিয়তির মারে বড় ক্লান্ত তিনি আজ , এবার বোধহয় নিদ্রার প্রয়োজন; আর বেশি  চিন্তা করতে পারেন না মাদ্রী।

                                                        ৭

সময় এগিয়ে চলেছে,  পিতামহ ভীষ্ম , মহামতি বিদুর যেকোনো মুহূর্তে এসে পড়বেন, হয়তো বা জ্যেষ্ঠতাত ধৃতরাষ্ট্রও।  গবাক্ষপথে মাদ্রী দৃষ্টিপাত করলেন কক্ষের বাইরে, পাঁচ পুত্র তাদের শোকস্তব্ধ  জননীকে  ঘিরে রেখেছে, বিষণ্ণ হাসি মাদ্রীর মুখে , এখানেও তিনি কোথাও নেই।  কুন্তী যেন তখন আরো  কি বলছিলেন, তাঁর পাটরাণীর অধিকারের কথা,  সহমরণে যাওয়ার কথা । কয়েক মুহূর্ত, মাদ্রী   সচেতন  হলেন, আরো দেরি হয়ে যাওয়ার আগে নিজের সিদ্ধান্ত স্পষ্টভাবে জানানো দরকার।   উঠে দাঁড়ালেন, এয়োতির উপযুক্ত শৃঙ্গার, মাথায় সিঁদুর, কপালে রক্তিম সন্ধ্যাসূর্য ,  পায়ে অলক্তক, কক্ষ থেকে বাইরে এলেন মাদ্রী। 


 আজ প্রথমবার দৃঢ় পায়ে, স্থির প্রত্যয়ে সপত্নী কুন্তীর সামনে এসে দাঁড়ালেন,  কুন্তী  সহদেবকে জড়িয়ে বসেছিলেন, তাকালেন মুখ তুলে। চিরকাল নির্দেশ তো কুন্তীই দেন, আজ মাদ্রীর  ইঙ্গিতে  অর্জুন সহদেবকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। বিস্মিত  কুন্তী ,তাঁর সামনে এক নতুন  মাদ্রী , স্বাভিমানী সংকল্পবদ্ধ এক নারী। মাদ্রী কথা বললেন কন্ঠস্বর  মৃদু ও আত্মবিশ্বাসী,


"  দিদি  আমি আপনার এবং আপনার পঞ্চপুত্রের অপরাধী। ঋষির অভিশাপ  জ্ঞাত  হওয়া সত্ত্বেও  আমি মহারাজকে সংযত করতে পারিনি। অরণ্যের মনমোহক পরিবেশে  ময়ূর দম্পতির মিলন , পাখিদের প্রেমসঙ্গীত , নদীর কুলুকুলু , বাতাসের মর্মর, মহারাজের  এতদিনের  অবদমিত কামনা,বাসনার স্রোত উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। আপনি অবিশ্বাস করতেই পারেন, কিন্তু আমি  বারম্বার নিষেধ করেছিলাম  মহারাজকে ।  আমার অপরাধ এতোটুকুই যে আমিও  ভেসে গিয়েছিলাম মহারাজের আহ্বানের আবেগে, নিজেকে সংবরণ করতে পারিনি। আমি নিশ্চিত আপনি হলেও পারতেন না। উত্তেজনার চরম মুহুর্তে  যখন চকোর চকোরী যথা প্রিয়সঙ্গমে মিলিত আমাদের দুজনের শরীর, মন , ঠিক সেই মুহুর্তে, অভাগিনী আমি ; সেই দুর্ভাগা ক্ষণে মহারাজের হৃদয়  উত্তেজনা সহ্য করতে পারলো না।  হস্তিনাপুর নরেশ মহাবীর পান্ডুর হৃৎস্পন্দন চিরদিনের মতো  স্তব্ধ হয়ে গেল। আমি নিশ্চুপ পড়ে থাকলাম মহারাজের বক্ষে।   এত বছরের বিক্ষিপ্ত নানান  স্মৃতি আমাকে তাড়া করছিল ।  আপনি দেবী কুন্তী , প্রিয় পুত্ররা , হস্তিনাপুরের জনগণ , পিতামহ ভীষ্ম ,কাকা বিদুর এদের সকলের নীরব  প্রশ্নের কি উত্তর আমি দেবো?  কিন্তু  দিদি এখন আমি স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি , এই অচেনা পথে মহারাজ পান্ডু একাকি যাবেন না । আমি তাঁর সহগামিনী হবো "। 

কুন্তী  এতক্ষণ চুপ করে শুনছিলেন, এখন কিছু বলতে উদ্যত হলে তাঁকে থামিয়ে দিয়ে মাদ্রী বলে চললেন, " নকুল আর সহদেব  আমার গর্ভের সন্তান  হলেও ওরা বেড়ে উঠছে ওদের বড়োমার স্নেহের আঁচলে ।  আমাদের পাঁচ পুত্রই  আপনার  বেশি অনুরক্ত।  তাই ওদের  জন্য আমার  মনে কোনো চিন্তার ভার  নেই । তাছাড়া পুত্রদের বিষয়ে আপনার মতো সমদর্শিতা আমি কখনোই  দেখাতে পারবোনা। আমি নিশ্চিত দেবী কুন্তী, আপনার, পিতামহ ভীষ্ম এবং তাত বিদুরের তীক্ষ্ণ নজরে ওদের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকবে,  শিক্ষালাভ করে  হস্তিনাপুরের মুখ উজ্জ্বল  করবে, এইমাত্র প্রার্থনা।  পাটরাণী হিসেবে  মৃত মহারাজের সাথে আপনার সহমরণে যাওয়ার অধিকার আমি চেয়ে নিলাম দিদি , আমাকে অনুমতি দিন "।  

                                                             ৮

তাকিয়ে থাকলেন কুন্তী, তাঁর শুস্ক চোখে নামলো  সপত্নী মাদ্রীর জন্য জলধারা। কুন্তীকে প্রণাম করে মাদ্রী এগিয়ে গেলেন মহারাজ পান্ডুর জন্য তৈরি অন্তিম শয্যার দিকে, স্বামীর মাথা কোলে নিয়ে বসলেন । মনে মনে বললেন,  “ আমিও  আমাদের সন্তানদের বড়ো হওয়া দেখতে চাই মহারাজ,  কিন্তু তবুও এ আমার স্বেচ্ছায় নেওয়া সিদ্ধান্ত। আমি চাইনা আমার  সন্তানরা  কোনো বিকট  পরিস্থিতিতে পড়ুক । দেবী কুন্তী অত্যন্ত  বুদ্ধিমতী, আমার যুবতী সুলভ চাপল্য থেকে যোজন হস্ত দুরে ,তিনি পরিস্থিতি সামলে নিতে পারবেন ।  পিতামহ ভীষ্ম ও মহাত্মা  বিদুর  হয়তো এখনই এসে পড়বেন । না,আমার ওনাদেরও আলাদা করে কিছু বলার নেই । আমি  দেহে মনে  সর্বাঙ্গীন প্রস্তুত  মহারাজ । আমিও  আসছি আপনার সাথে সেই নতুন জগতে, যেখানে ক্রোধ নেই ,ঈর্ষা ,সঙ্কীর্ণতা নেই  আছে শুধুই প্রেম সেই অমৃতের  উদ্দেশ্যে হবে আমাদের যাত্রা”  । 

মাদ্রী  শেষবারের মতো বিশ্বচরাচরের সৃষ্টিকর্তাকে  প্রণাম জানিয়ে যোগনিদ্রায় প্রাণত্যাগের জন্য চক্ষু নিমীলিত করলেন।