বিসর্জন
বাবা-মা আদর করে নাম রেখেছিল সূ্র্য। নামের সাথে আমার চরিত্রের কোন মিল নেই বলেই
হয়। গোধূলি বেলার রূপ, মন আঁকড়ে ধরে সেই মুহূর্তেকে। ভালো লাগে সূ্র্য উদয়,ভালো লাগে সূ্র্য অস্ত। তা হয়তো আমার ছিল। কিন্তু এক বিন্দু সূ্র্যের তেজ আমার মধ্যে ছিল না। সিদ্ধান্ত নেবার মতো কোন ক্ষমতা আমার বিন্দুমাত্র ছিল না। জীবনের চলার পথে প্রথমেই একটা মস্ত বড় ভুল করে বসলাম।
অনেক অল্প বয়স থেকেই টিউসান করতাম। বহু ছোট, বড় স্কুল, কলেজের ছেলে-মেয়েরা পড়তে আসত। তাদের মধ্যে বিশেষ দু’জন ছিল নদী ও তার ছোট বোন ঝর্ণা। নদী একটু বেশি সংসারি। মা-বাবার সাথে জমিয়ে সংসারের গল্প করত। আমার অসহ্য লাগত। মায়ের কিন্তু খুব পছন্দের মেয়ে। কলেজে চাকরি পাবার পর মা প্রায় ওর কথা বলত। পাত্তা দিতাম না। ঝর্ণা আমার চেয়ে অনেকটা ছোট, তাই মুখ খুলে ওর কথা কাউকে বলতে পারেনি। ঝর্ণাকেও কোন দিন বলেনি। ঝর্ণা বলতো, খুব সহজ ভাবেই বলতো। নানা রকম ঠাট্টা, ইয়ার্কি,জোক! যত ভাবতাম গম্ভীর হবো, হতে পারতাম না, হেসে ফেলতাম। “একদিন বলল, যেদিন তুমি আমায় ‘I LOVE YOU’ বলবে, “সারা কলকাতার শহরের আকাশে বেলুনের সাথে গোলাপ দিয়ে এক টুকরো কাগজে লিখে দেব আমার ভালোবাসার মানুষ ‘কি করছে’? --সেই ছেলে বেলা থেকে আমার আঙ্গুল গুলো লেখা পড়ার অজুহাতে সময়ের বেশি ধরছে, অথচ হাতটা ধরতে পারলো না আজ পর্যন্ত”। লাভ ইউ তো অনেক দূরের পথ। আমি মাথায় চাটি মারতাম। হেসে গড়িয়ে পরতো। নদীর উল্টো শ্রোত। ঝর্ণা হয়ে প্রকাশ। বয়ে চলেছে আপন মনে আপন বেগে। ছেলে বেলার কথা প্রায় মনে পড়ে। তখন ওর বয়স কতই বা হবে পাঁচ-ছয়, আমি এগারো-বারো। দূ্র্গা মন্ডবে ঠাকুর দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম,মা দূর্গার মুখ আর ওর মুখ যেন মিলে মিশে একাকার।–বললাম ‘তোমার মুখ, ঠাকুরের মুখ এক রকম। ঝলমল করছে প্রদীপের আলোয়। বলল, ‘তবে আমরা হয়তো এক সাথে বিসর্জন যাবো’। ভয় পেয়ে জড়িয়ে ধরলাম’। ছেলে বেলা থেকেই কেমন যেন মায়ার বন্ধনে জড়িয়ে পড়ে ছিল।
সদা হাস্য মুখ। খোলা হাওয়ার মতো। দিদির সাথে কোন মিল নেই। সবার আগে আসত সবার পরে যেত। বাবার সঙ্গে দাবা খেলে কিংবা মাকে পটিয়ে বেগুনি ভেজে সকলকে খাইয়ে হৈচৈ করে বাড়ি ফিরত। আমার চেয়ে প্রায় সাত বছরের ছোট।ভাব ভঙিমা ছিল যেন আমার গার্ল ফেন্ড। প্রথম যেদিন কলেজে ভর্তি হলো সারা কলকাতা আমাকে নিয়ে ঘুরে, নিজামে বসে বিরিয়ানি খেলাম দু’জনে। ভালোই লাগতো ওর সঙ্গ। পাশ করতেই তিনটে টিউসানিও জোগার করে ফেলল। আমার জন্মদিনে দেখি বালিশের নিচে একটা দারুন পাঞ্জাবী, ‘চিরকুটে লেখা, আজগের দিনের গিফট, বিশেষ দিনে বিশেষ উপহার! মূল্য দিয়ে কেনা ষায় না, এমন উপহার দেব’। পাজ্ঞাবিটা পরতেই কোথা থেকে একটা রজনী গন্ধার মালা এনে গলায় পড়িয়ে দিল।বললাম, ‘বিয়ে হয়ে গেল কিন্তু’—‘বলল,অনেক দিন আগে হয়ে গেছে.মনে মনে’। বাইরে পায়ের শব্দ শুনে পালাল।
কিছুক্ষন বাদেই নদীর বাবা, আমার বাবা,মা, সঙ্গে নদী সবাই হাসি খুশি মেজাজে ঘরে ঢুকল। সূ্র্যকে উদ্দেশ্য করেই নদীর বাবা রমানাথ বোস বলল, “আজ একটা শুভ প্রস্তাব নিয়ে তোমার কাছে এসেছি সূ্র্য, মনে হয় আমাকে তুমি ফিরিয়ে দেবেনা। দুই পরিবার মিলে ঠিক করেছি খুব শী্ঘ্র তোমার সাথে নদীর বিয়ে দেব”।
--‘না, বেয়াই মশাই, ওর মা যখন কথা দিয়েছে, আমার ছেলে মায়ের অবাধ্য কোন দিন হবে না’। সূর্য চুপ করে রইল। দূরে দু-চারজন বন্ধু নিয়ে বসে ছিল ঝর্ণা, বলল, “বাক রুদ্ধ মানে একশ ভাগ রাজি”। সেদিন আরও বেশি হৈচৈ করে বাড়ি চলে গেল।
ঝর্ণাকে আর বেশ কিছু দিন দেখা গেল না। নদী এসেই সূ্র্যকে খবর দিল। বলল, ‘তোমার প্রিয় বন্ধু এত বেইমান! পিসিমাকে দেখে আসি বলে আসানসোল চলে গেল। আর ফিরবে না বলেছে। বাবা-মা ফোনের পর ফোন, কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। পিসিমার ভালোবাসার ধন। দারুন খোশামদ করতে পারে। ওখানে ওর বন্ধুর বাবার অফিসে চাকরি নিয়েছে। নাইট কলেজে ভর্তি হয়েছে’। “ভালো তো”! ‘সূর্য বই থেকে মুখ না তুলেই উত্তর দিল। নিজের পায়ে দাঁড়াবে। এ তো ঈশ্বরের মস্ত বড় আশীর্বাদ। সকলের এত মনের জোর থাকে না’। নদী এবার কড়া গলায় বলল, “আমি জানি, তোমার ওর ওপর একটু দূর্বলতা আছে”। --‘জেনে শুনে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিলে? কি করে আমাকে বিয়ে করতে রাজি হলে, এখনও সময় আছে চিন্তা করে দেখ’!নদী ঘর খেকে যাবার আগে বলে গেল—“এ বিয়ে আমি করবই, এবং শেষ দেখা দেখব”। সূ্র্য কলেজের খাতা দেখছিল, ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে শুয়ে পড়ল। এতো মানসিক অশান্তি জীবনে এই প্রথম। সূর্যের বাবা-মা বোধহয় কিছু ঈঙ্গিত আগে থেকেই পেয়েছিল। পাখার হাওয়ায় সাদা কাগজ সারা ঘরে বন বন করে উড়ছে।যেন কাল বৈশাখী ঝড় উঠেছে। ঘর অন্ধকার।
--মা বলল, ‘আর কটা দিন বাদেই তোদের বিয়ে, কিসের জন্য মেয়েটার সাথে এত ঝগড়া। তোর হাঁটুর বয়সি একটা মেয়ে তোর পছন্দ, একটা উড়োন চন্ডি! কোন সংসারের জ্ঞান নেই, দিন রাত নেচে বেড়াচ্ছে অসহ্য’! সূর্যের বাবা সমীর, আর চুপ করে থাকতে পারল না। নিজের স্ত্রী লীলাকে বলল, “তুমি কিন্তু আমার চেয়ে ছ’ বছরের ছোট।দুটো বছর যেতে না যেতে সকলকে কাঁচি দিয়ে কেটে জাঁকিয়ে সংসার করলে । সুস্থ মানুষ গুলোকে ঘরে বন্দী করে”। লীলা চেয়ারে বসে পড়ল।
--বলল, ‘সূর্য তোর মনের কি ইচ্ছে, এত বছর বাদে তোর বাবা আমাকে এত বড় অ্পমান করল’। সূর্য ধীর স্থীর ভাবে বলল, “আমার কোন মতামত না নিয়েই তোমরা সব ঠিক করে ফেলেছ। নদী একরকম অসুস্থ। এই ঘটনার পর ঝর্ণা কোন দিন হয়তো বিয়েই করবে না। নদীকে বিয়ে না করলে এমন ঘটনা ঘটাবে আমাকে জেল হাজতে বাস করতে হবে। ঐ মেয়ে প্রথমেই রান্না ঘর, তারপর আমার টাকা। এখন থেকেই হিসেব শুরু করে দিয়েছে। আমার আগামী দিন গুলো বিসর্জন দিলাম ভবিষ্যতের ঘন অন্ধকারে”।
--না সূর্য, আমি তোর মা বলছি, “সব ঠিক হয়ে যাবে”। বাবা বলল, ‘সব ঠিক হবে সত্যি! আমার ছেলের হাসিটুকু চির কালের মতো হারিয়ে গেল’।
পাশাপাশি দুটো বাড়ি। দুই বাড়িতে সানাই এর করুন সুর। সানাই এর সুর যদি আনন্দের দিনে বাজে। এক অজানা ভালোবাসার গন্ধ।সানাই এর সুর যদি নির্জনে মন খারাপের দিনে বাজে করুন বিসাদের সুর। সুর্য আরো চুপচাপ হয়ে গেল। সন্ধ্যা বেলা পায়ে হেঁটেই এলো নদীকে বিয়ে করতে। ঢোকার মুখেই একটু দূরে তার বিশেষ কিছু বন্ধু নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ঝর্ণা।
হেসে হাত নাড়াল সব বন্ধুরা। সূর্য দেখল. সাদা ঢাকাই শাড়ি। মাখায় সাদা জুঁই ফুলের মালা। সূর্যের দেওয়া লুকনো উপহারের শাড়ি। এক মাসে কত বড় হয়ে গেছে, সূর্য মনে মনে বলল,ওকে নিয়েই আমার চলার পথ। পাশে নেই, কাছেই আছে। মন ওর গলায় মালা দেবে। সিদুঁর চোখ বন্ধ করে ওর মাথায় দেব। অনেক দিন আগেই একটা মধুর সম্পর্কের গাঁটছড়া বাঁধা হয়ে গেছে ওর সঙ্গে। বিয়ের সমস্ত নিয়ম কানন নিখুঁত ভাবে সম্পন্ন হলো।বিয়ে হয়ে গেল নদীর সাথে।নদী হাত বাড়িয়ে হাত মেলাল সূ্র্যর সাথে। সূর্য মালা, টোপর খুলে রেখে বিয়ের আসর থেকে বেড়িয়ে গেল।
বিয়ে বাড়ি থমথমে ভাব। সকলের মুখে নানা কথার গুঞ্জন। পাড়ার প্রায় অল্পবয়সি ছেলে-মেয়েরা অনেকেই দেখেছে বা জানে সূর্যর সাথে ঝর্ণার সম্পর্কের কথা। দুই বাড়ির অভিভাবকরা ভালো মতো জানত। ভেবে নিয়ে ছিল ছেলে মানুষ এর খেলা।সব চেয়ে বেশি অসহ্য হয়ে ছিল নদীর কাছে। নদী থাকতে কি করে পছন্দ হতে পারে ছোট বোনকে। তাই সূ্র্যের জন্মদিনের দিনই বাবাকে দিয়ে জোর করেই বিয়ের প্রস্তাব করালো। হিংসে, রাগ, মানসিক অবসাদে দিবারাত মানসিক রুগী হয়ে পড়ে ছিল নদী। ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকত। ঝর্ণা আলো জ্বালিয়ে দিদিকে জড়িয়ে ধরলেই প্রচন্ড রেগে উঠত, মাঝে মধ্যে মারধোর করত। ওর সরল মন এই অজানা তথ্য বুঝে উঠতে পারেনি। তাহলে হয়তো অনেক দিন আগেই নিজেকে সরিয়ে নিতো সূর্যের কাছ থেকে।
সূ্র্যের বাবা সকলের আড়ালে ঝর্ণাকে নিজের বাড়ি নিয়ে গেল। পথে যেতে যেতে যেতেই বলল, “যা ঘটনা ঘটবার ঘটে গেছে। তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। ছেলেটা আমার সকলের মান রাখতে চুপ করে ছিল সেই মূহু্র্ত্তে।
তুমি আনন্দময়ী মা। নিজেকে বিসর্জন দিলে সংসারের মঙ্গলের জন্য। তুমি বুঝিয়ে বললে তোমার কথা শুনবে। কি বলবে, আমার চেয়ে তুমি ভালো জান। আমি নীচে আছি। কিছুটা সময় তুমি ওর সঙ্গে থাক”।
ঘর অন্ধকার করে শুয়ে ছিল সূ্র্য। সারা বাড়ি নিঃশব্দ। ঝর্ণা কিছুক্ষন পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে রইল।মনে মনে ভাবল কাকে সান্তনা দেব নিজেকে,না সূর্যকে।এই প্রথম ঘরে ঢুকতে এত দ্বিধা। একমাস ধরে নিজের সঙ্গে লড়াই করে নিজেকে সংযত করেছে। পরিবারের সকলের আনন্দের জন্য নিজেকে বিসর্জন দেয়ার চেয়ে বড় কিছু পৃথিবীতে নেই। মা দূর্গা আসেন সেই কৈলাশ থেকে, মাত্র পাঁচটি দিনের জন্য। আকাশে বাতাসে তার আগমনী গান। ভরে উঠে আনন্দ ধারা পৃথীবির বুকে। হাসি মুখে বিসর্জন,সকলের মঙ্গল কামনা করে।
ঘরে গিয়ে পাশে বসলো। সূ্র্য জরিয়ে ধরে কেঁদে উঠল। এই প্রথম একজন পুরুষ মানুষের কান্না মনকে তোলপাড় করে দিল। মনের চাওয়া-পাওয়াকে সংয়ত করা যায়। বাস্তবের চাওয়া-পাওয়াকে বোঝান বড় মুস্কিল। তবু ওর মাথায় হাত রেখে বলল, “তোমার এই ভাবে চলে আসা ঠিক হলো না। যে কারনে তুমি বিয়ে করতে বাধ্য হলে, সেই ঘটনা আজও হতে পারে। হয়তো আরও ভয়ঙ্কর রুপ।দিদি মানসিক ভাবে অসুস্থ। দু-হাত দিয়ে সূ্র্যকে জরিয়ে ধরে বলল, আমার যা কিছু আছে তোমায় দিলাম।মাথা থেকে জুঁই ফুলের মালা খুলে সূর্যের গলায় পড়িয়ে দিল। অন্ধকার ঘরে ফুলের গন্ধে সানাই এর সুরে চোখের জলে দুটো মানুষের বাসর রাত্রি স্বাক্ষর হয়ে রইল দুটো মন। ঝর্ণা বলল, বহুবছর আগে ঠাকুমার কাছে গল্প শুনেছিলাম, বহু সংসারে নিয়ম ছিল বিবাহের প্রথম রাত প্রথমে গুরুর ঘরে, তারপর স্বামীর ঘরে। আমি গুরু দক্ষিণা দিলাম নিজেকে বিসর্জন দিয়ে তোমার চরণে। আমাকে গ্রহন করো।শব্দের প্রথম অক্ষর তোমার হাত ধরে। জীবনের চলার পথের শুরু। আজ থেকে তুমি কেবলমাত্র দিদির। আমার চেয়ে অনেক অনেক বেশি ভালোবাসতে হবে দিদিকে। দিদিকে সুস্থ করে দিতে হবে। কথা দিলে কিন্তু”!
সুর্য ধীর গতিতে এগিয়ে গেল বাসর ঘরের দিকে। একজন পড়ে রইল অন্ধকারে নিজেকে বিসর্জন দিয়ে তার কাছের মানুষের কাছে।