জারুল ফুল
সঞ্চারী সাধু
" মা এই গাছটা বড় হলে ফুল হবে?" অজস্র কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করে ছোট্ট মিতুল।
“উওরে তার মা রেণুকা বললেন," হবেই তো! এটা হলো জারুল ফুলের গাছ।একদিন এটা খুব বড় হবে, তখন সারা উঠন জুড়ে পড়ে থাকবে জারুল ফুল।তুমি রোজ এতে অল্প অল্প জল দেবে কেমন?"
মিতুল উত্তরে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ায়।
রেণুকা - " মিতুল যখন আমি থাকবো না তখন এই গাছটা থাকবে। আমি প্রতি বসন্তে জারুল ফুল হয়ে তোর কাছে আসব।"
ছোট্ট মিতুল খুব একটা বুঝল না মায়ের কথাটা কিন্তু সে এখন খুব খুব খুবই খুশি।
ক্লাস টুতে পড়ে বারাসাতের মিতুল গুপ্ত। বাবা অজয় গুপ্ত একটা বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত, তিনি বড়ই ব্যস্ত। মিতুলের কোটা জগত জুড়ে অবস্থান করছে তার মা, আর যত আঁকা ছবি সবই তার বাড়ির সামনের দিকের উঠোনের পাশের ছোট বাগানটাকে নিয়ে। রেণুকার যত্নে সজীব আছে কাজগুলো তবুও মিতুল সবাইকে বলে " আমিই গাছগুলোতে জল দি। খুব যত্ন করি।" সুতরাং মিতুল মনে করে বাগানের বিষয়ে সকল প্রশংসা তারই প্রাপ্য।
মিতুল তার মায়ের কথা অনুযায়ী খুবই যত্ন
করে ওর প্রিয় জারুল গাছটাকে। ঠিক যেনো মিতুলের সাথে সাথেই সেই ছোটো চারা গাছটাও বড় হতে লাগল। এখন তাতে অনেকগুলো কচি কচি পাতা ধরেছে। মিতুলকে তার মা বলেছে গাছটা আরো কিছুটা বড় হলো ফুল হবে বেগুনি রঙের ছোট ছোট ফুল। জারুল গাছে ফুল দেখার জন্য মিতুল সারাক্ষণ অধীর অপেক্ষায় থাকে। তবে সদা ব্যাস্ত অজয় গুপ্তের স্ত্রী ও কন্যার জন্য সময় প্রায় নেই বললেই চলে। বিয়ের দশটা বছর পার হয়ে যাওয়ার পর রেণুকার প্রতি অজয়ের ভালোবাসাটা ফিকে হয়ে এসেছে, সেটা রেণুকা ভালই বুঝতে পারে। কিন্তু তার কোনো অভিযোগ নেই স্বামীকে নিয়ে। কিন্তু ঈশ্বর বোধ করি সংসারে অভিযোগহীন ব্যাক্তিকে পছন্দ করেন না। তাই এমন মানুষদের উপরেও অভিযোগের কারণস্বরূপ যথেষ্ট পরিমাণে আঘাত বা বোঝা দিয়ে দেন।
মিতুলের বয়স যখন সময়ের স্রোতে পনেরো বছরের কাছাকাছি তখনই হটাৎ সব ওলট - পালট হয়ে গেলো। রেণুকার লিভারে যে কান্স্যার বাসা বেঁধেছে সেটা জানা গেলো। হটাৎ ঝড়ের দাপটে মাঝ নদীতে যেভাবে নৌকা উল্টে পাল্টে যায় সেইভাবেই মিতুলের জীবনটাও উল্টে পাল্টে গেলো। ঠিক নৌকার ভেতরের মানুষগুলোর মতোই সে ছটফট করতে লাগলো। রেণুকার মা, বিশাখা দেবী জামাইয়ের উপর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হলেন। তিনি তাড়াতাড়ি এসে জোর করেই রেণুকাকে নিয়ে চলে গেলেন বেহালার ফ্ল্যাটে। সেখানে রেণুকার মা, বাবা, ভাই ও এক কাকা থাকে। রেণুকাকে সেবা যত্নে সুস্থ করে তোলাই ছিল বিশাখা দেবীর উদ্দেশ্য।
প্রচন্ড শারীরিক কষ্ট সহ্য করতে হলো ধীর শান্ত সরল স্বভাবের রেণুকাকে। আর মিতুল তার কী অবস্থা? যে মেয়ে মাকে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারে না তার কী অবস্থা?
যার গোটা জগৎ জুড়েই মা অবস্থান করছে সে
কেমন আছে?
সত্যি ভালো নেই সে। মেয়েটা ঠিক মতো খায় না ঘুমো হয় না। চোখের নিচে কালি জমেছে। জামা কাপড় মলিন। মিতুল বিশাখা দেবীর থেকে মায়ের কাছে থাকার অনুমতি পায় না। অজয় মাঝে মাঝে আসে রেণুকার সাথে দেখা করতে। অজয় চায় না তার মেয়ে এইখানে বেশিদিন থাকুক।
অজয় - " রেণু , তোমাকে একটা কথা বলতাম।"
রেণুকা - " বলো"
অজয় - " তুমি কথাটা খারাপ ভাবে নিয়ো না। আমি ভালোর জন্যই বলছি।"
একরাশ হতাশা মিশ্রিত কণ্ঠে রেণুকা জবাব দেয় - " আমি ভালো খারাপ কিছু নিয়েই
ভাবতে চাই না। বেশিদিন সময় নেই তাই সব ভাবনা চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিতে চাই। শুধু মিতু"
রেণুকার কথা মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে অজয় বলে -" হ্যাঁ মিতুকে নিয়েই বলতাম"
রেণুকা -" বলো"
অজয় -" মিতুকে আমি আজই বারাসাত নিয়ে যেতে চায়। ওর এখানে পড়াশোনা হচ্ছে না। আর বলতে খুব খারাপ লাগলেও এখানে মিতুর কোনো যত্ন হচ্ছে না। তোমার কাছে ওকে আসতে দেওয়া হয় না তাই তুমি জানো না। অবশ্য তোমার এই অবস্থায় তোমাকে কিছু বলাই উচিত নয়। মিতু ঠিক করে খায় না ঘুমায় না। চোখের নিচে কালি পড়েছে মেয়েটার। আমি খুব খারাপ মানুষ হলেও নিজের মেয়ের এই অবস্থা দেখতে পারছি না।"
একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে রেণুকা বললো -" মিতুকে একবার আমার কাছে নিয়ে এসো।
আমি ওকে বুঝিয়ে বলছি।"
মিতুল ঘরে ঢুকতেই চোখে জল এসে যায় রেণুকার চোখে। তার সোনার টুকরা মেয়েটা অর্ধেক হয়ে গেছে! কতদিন কতো কেঁদেছে তার কোনো হিসাব নেই। এইদিকে দাড়িয়ে দাড়িয়ে মিতুল কান্নায় ভেঙে পরে। কোথায় তার সেই মা! বিছানার সাথে মিশে গেছে কঙ্কাল সার একটা মানুষ , মাথায় একটাও চুল নেই। সারা মুখ শুকনো ফ্যাকাশে।
বহু কষ্ট অশ্রু সংবরণ করে রেণুকা মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে বলে -" মিতু তুই আর এখানে থাকতে পারবি না। আজকেই তোকে বাবার সাথে বারাসাত যেতে হবে।"
এমন কথা শুনতে হবে মায়ের মুখ থেকে সেটা ছোট্ট মিতুল দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করেনি। প্রচন্ড কান্নার বেগ সামলাতে না পেরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। মিতুল কিছুটা শান্ত হলে রেণুকা বলে -" মিতু তুই জারুল গাছটার কথা ভুলেই গেছিস।
ওর একটুও যত্ন হচ্ছে না।"
অভিমানের সুরে মিতুল বলে -" কেনো মা? বাড়িতে শোভা পিসি আছে তো।"
রেণুকা -" না রে আমার একদম শোভাকে ভরসা হয় না। তুই যা সোনা। আমি তো কিছুদিন পরেই আসবো।" এই বলে মেয়ের মাথায় সস্নেহে একটা চুম্বন করে রেণুকা। রেণুকার হৃদয়ে যে বিশাল আকারের প্রস্তর খন্ড রেখে মিতুলকে বারাসাত পাঠালো তার ভার হয়তো একমাত্র মায়েরাই অনুধাবন করতে পারবেন।
এরপর ইহজীবনে মিতুলের সাথে আর কোনোদিন দেখা হবে না জানতে পারলে রেণুকা কি আর একটু বেশিক্ষণ কি বুকে জড়িয়ে রাখতো না? মিতুলকে যেতে দিতে পারতো সে? আর মিতুল সে যদি জানত!
মিতুলের মা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে প্রায় ছয় মাস আগে। একদিন রাতে হটাৎ বাড়াবাড়ি হতেই দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অজয় পৌঁছানোর আগেই রেণুকা অনেক দূরে গেছিল। রেণুকাকে শেষবারের মতো দেখতে মিতুলকে নিয়ে আসা হয়েছিল। সে দেখেছিল তার মা ঘুমোচ্ছে। মা যখন ওর পাশে ঘুমোতো সেই ঘুমের সাথে এই ঘুমের অনেকটাই পার্থক্য। তার মায়ের সুন্দর মুখটা গ্রাস করেছে কোথাকার ঘনান্ধকার। ওর মা আজ বড্ড বেশি নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। এতটা নিশ্চিন্তে তো মায়েদের ঘুমোতে নেই। মায়েদের সজাগ হয়ে ঘুমোতে হয়। রেণুকা নতুন শাড়ি পড়েছে তবুও আগের মত সুন্দর দেখাচ্ছে না। সবাই মিতুলের ঘুমন্ত মাকে সাজিয়ে দিচ্ছে তবু যেনো তাকে সুন্দর দেখাচ্ছে না।
মিতুল যতই ভাবতে লাগলো মা আর তাকে ডাকবে না, আর খেতে বলবে না আর রান্না করে দেবে না আর ঘুম পারাবে না আর সাজিয়ে দেবে না আর গাছ বসবে না আর
চকলেট এনে দেবে না, মা আর তাকে ভালোবাসবে না ততই তার মাথার ভেতরে সব অন্ধকার হয়ে যেতে লাগলো। নিজের অজান্তেই মাটিতে পড়ে গেল মিতুল। মৃত্যুর করাল গ্রাসের শিকার ওর মা - এই কথাটা যতই মিতুল তার মাথায় ঢোকাতে লাগলো ততই তার চারপাশের অন্ধকারের গভীরতা বেড়ে যেতে থাকলো।
শারীরিকভাবে সুস্থ হতে মিতুলের প্রায় তিন মাস সময় লেগেছিল। কিন্তু যে মানসিক ক্ষতি হলো সেটা কি জীবনেও পূরণ হবে? মায়ের জায়গা কি কেউ কোনোদিন পূরণ করতে পারে? আজকাল মিতুল স্কুলে গিয়ে লাস্ট বেঞ্চে বসে থাকে। বন্ধুদের সাথে কথা বলা ছেড়ে দিয়েছে। খুব কম খায়, রাতে চোখের পাতা এক করতে পারে না। চোখ দুটো কাউকে খুঁজে বেড়ায়। হয়তো তার দেখা কোনোদিন পাওয়া যাবে না তবুও অবুঝ মানব হৃদয় তারই সন্ধান করে। মিতুল জারুল গাছটার একটু বেশি ভালোবাসে।
শীতের এক দুপুরে স্কুল ছুটি মিতুল ওই জারুল গাছের নিচে বসে আছে। গাছটা বেশ বড় হয়েছে অনেক ফুল ফুটেছে, হাল্কা বেগুনি রঙের ফুল। হঠাৎ একটা ফুল উত্তরের হওয়ার ধাক্কায় মিঠুনের মাথায় পড়েই ওর হাতে এসে পড়ল। শিহরিত হয়ে উঠলো ও। ফুলের নরম পাপড়ি ঠিক যেনো মায়ের নরম আঙ্গুলের স্পর্শে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। ঠিক মায়ের মত স্নেহাদ্র স্পর্শ । তবে কি মা? মিতুল একবার গাছটার দিকে তাকালো। ওর শরীর মন অপার্থিব স্নেহে পরিপূর্ণ হয়ে গেলো। ওর মা তো বলেছিল প্রতি বসন্তে জারুল ফুল হয়ে ফিরে আসবে। মা কি সত্যি এলো? মায়েরা কী কোনদিন হারায়? আমরা যাদের ভালোবাসি তারা কি কোনদিন হারায়? হয়তো প্রতি বসন্তে জারুল ফুল হয়েই আমাদের কাছে ফিরে আসে।