বহুলাক্ষী কথা 

 রিয়া পোদ্দার 

 

সেদিন ছিল কালি পুজো এ ঠিক দু তিন দিন আগের কথা,এই সময়টা অর্থাৎ দুর্গা পুজোর থেকে শীত কাল পর্যন্ত সতী পীঠ দর্শনের একটা আবেগ কাজ করে আমার বাবাই ওরফে বাবার মধ্যে।পশ্চিম বঙ্গ এর এটি ছাড়া আর ২টি বাকি তাহলে পশ্চিম বঙ্গ এর সতী পীঠ দর্শন পূর্ণ হবে। তাই সকাল সকাল স্নান পুজো সেরে কাটোয়া র উদ্দেশ্য বেরিয়ে পরা সেখান থেকে বর্ধমান গামী রাস্তায় কেতুগ্ৰাম এ মা বহুলাক্ষী র বাস। ছিমছাম নিরিবিলি পরিবেশ মাটির দোতলা বাড়ি র সাথে আধুনিক মার্বেল বাড়ির সামঞ্জস্য এর মতো পাশাপাশি পরিবারের মতো বাস করে দুই পৃথক ধর্মাবলম্বী মানুষ জন , মসজিদ মন্দির হাত ধরাধরি করে অবস্থিত। সামনে গলির রাস্তা বাজার স্কুল পেরিয়ে কিছুটা গেলেই গ্ৰীলের গেট দেওয়া মন্দির পাশে দিঘি, সেখান থেকে জল দিয়ে মায়ের পুজোর কাজ কর্ম করা হয়। মন্দির এ সকালে পুজো হয় ১০টার সময় , আমরা ওখানকার জন্য ফল মিষ্টি মালা ধুপকাঠি মোমবাতি কাটোয়া শহর

 

থেকে কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম। মন্দিরে সামনে আছে বিশাল চাতাল নাটমন্দিরের ,পাশে মায়ের ভোগ ঘর। অপেক্ষা করতে ঠাকুর মশাই এসে হাজির,একে একে পুজো নিয়ে হাজির গ্ৰামবাসী ও। সবার নাম গোত্র বলে পুজো দিয়ে অঞ্জলী দেওয়া হলো। এবার দুপুরে এ মায়ের ভোগের জন্য টিকিট কাটতে হবে, সেই মতো পাশের ভোগ ঘরে মায়ের ভোগের জন্য তরকারি বানাচ্ছিলেন শুভ্রার মা, এদের শরিকেরা ১২-১৪ কয়েক ঘর পালা করে নিত্য পুজো পরিচালনা করেন , রোজকার ভোগ যার যেদিন পালা সে সেদিন করেন। টিকিট মূল্য ৬০ টাকা, ভাবছেন শুভ্রাকে? সেদিন যাদের রান্নার পালি ছিল সে হলো শুভ্রার বাপের বাড়ি লোক। শুভ্রার স্বামী বাইরে চাকরি সূত্রে থাকায় ও এখানে ছেলে মেয়ে নিয়ে থাকে বাবা মায়ের কাছে।আজ ওদের পালা বলে ও রান্নার কাজে মাকে সাহায্য করতে এসেছে,প্রায় সম বয়সী হওয়ার সুবাদে ভাব জমে গেছিলো কয়েক ঘন্টাতে। হাতে বেশ খানিকটা সময় বাবাই বাজার থেকে চপ মোটা আউস মুরি নিয়ে এলো

 

সেই দিয়ে জলযোগ সেরে চললাম,শুভ্রার আবদারে ওর বাড়িতে। পুরানো শিব মন্দির পেরিয়ে গ্ৰামের মন্দিরে র পেছনে ওদের মাটির দোতলা বাড়ি,নিকানো ঝকঝকে তকতকে উঠোন। গিয়ে দেখি ওর ছেলে মেয়ে গুলো পড়ছে, খানিকক্ষণ গল্পও করার ফাঁকে খেতে দিল নারকেল নাড়ু তিলের নাড়ু সিড়ির নাড়ু কি আন্তরিক ব্যবহার, এদের মন মানসিকতা কে এখনো শহুরে দেখনদারী আদব কায়দা ছুঁতে পারেনি ভাগ্যিস।কথায় কথায় জানলাম এই মন্দিরে মায়ের বাহু পড়েছিল,পাশে আছেন অষ্টভূজ গনেশের মূর্তি সারা পৃথিবীতে এই মূর্তি দু জায়গাতেই আছে। মায়ের কষ্টি পাথরের  চতুর্ভুজ দুর্গা মূর্তি, দক্ষ যজ্ঞের সময় সতীর দেহ ত্যাগের পর নারায়ণ এর সুদর্শন চক্র এর আঘাতে মা সতীর দেহ ৫১ টি টুকরো হয়ে পড়েছিল নানা জায়গায়।সে সময় এখানে পড়ে মায়ের বাহু।পরে রাজা চন্ত্রকেতুর নাম অনুসারে এই স্থানের নাম হয় কেতুগ্ৰাম। রাজা স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই মন্দির নির্মাণ করেন। মূর্তি আরেক পাশে কার্তিক।এই মন্দিরে মায়ের ভৈরব ৩কিমি

 

দূরে শ্রী খণ্ড গ্ৰামে ভূতনাথ লিঙ্গ ভৈরব ভীরুক।এই সব শুনতে শুনতে এসে হাজির এক কৃষ্ণ সাজা বহুরূপী দাদা গান করতে করতে।এমন সময় আমার বাবাই মাম ও এসে হাজির কারণ এবারে গন্তব্য শ্মশান আশ্রম আর নারায়ণ আখড়া। পুঁচকে দুটোকে সামনের মনোহারী দোকান থেকে চকলেট কোল্ড ড্রিংকস কিনে পা বাড়ালাম মেঠো পথ ধরে দুপাশে ক্ষেত জনমানবহীন। দুপুরে পাখি র কলরব ছাড়া কিছু শোনা যাচ্ছে না। অনেকটা এগোতেই পেলাম নারায়ণ মন্দির ও আখড়া, সেখানে নারায়ণের চতুর্ভুজ মূর্তি স্থাপন করা, পাশে বৈষ্ণব আখড়া। বিশাল পরিধি নিয়ে এই জনমানবহীন গ্ৰামের বাইরে আখড়া। সেখান থেকে এগোতে একটা বিশাল নদী,বলা হয় এটা মরী গঙ্গা যার ওপর দিয়ে সাঁকো পার হতে হয়।নদী পেড়িয়ে বিশাল জঙ্গলের মধ্যে শ্মশান আশ্রম, মায়ের হোম পুজো ভোগ হয় তন্ত্র মতে, থাকার জন্য জঙ্গলের মধ্যে মন্দিরে গেষ্ট হাউজ আছে, আগে থেকে বুকিং করতে হয়।গা ছমছম করা পরিবেশ পাশে শ্মশান থেকে ভেসে আসছে

 

পেঁচার ডাক আর পোড়া গন্ধ নাকে লাগছে, চারিদিকে ঘন জঙ্গল পাখির ডাক ছাড়া কিছুই শব্দ শুনতে পাওয়া যাচ্ছে না। সেখানে থেকে ফিরলাম ততক্ষণে মায়ের ভোগ আরতি হয়ে গেছে ভোগ ঘরের চাতালে কলাপাতা পেতে শুভ্রার মা পিসি আমাদের সাথে অনেকের খাওয়ার আয়োজন করলেন। প্রথমে গরম অন্ন পাট শাক বড়ি দিয়ে আলু দিয়ে ঘন্ট,আলু পটল বেগুন ভাজা, কলাইয়ের ডাল, বাঁধাকপি ঘন্ট,আলুপোস্ত, সয়াবিন রসা ফুলকপি দিয়ে,টক, পায়েস।পরম তৃপ্তি করে খেলাম মায়ের ভোগ, তবে আজ মাছ ভোগ হয়নি। এবার খাওয়ার পর দুপুরে নাটমন্দির এ বসলো সবার সাথে গল্পের জমাটি আসর, জানলাম দোলের সময় আর দুর্গা পুজোর সময় বিশাল আয়োজন করা হয়, প্রচুর মানুষ কে প্রসাদ বিতরণ করা হয়, নাটক নাচ গানের অনুষ্ঠান হয়।কথায় কথায় সময় কড়া নাড়লো অতত্রব আবার আসবো কথা দিয়ে উঠে পড়লাম, হঠাৎ করে এক পোটলা নাড়ু মোয়া জোর করে হাতে গুঁজে দিলো শুভ্রার মা ওরফে জেঠিমা,শুনলেন না কিছুতেই বললেন পথে খেয়ো,কয়েক ঘন্টার আলাপে বড় আপন হয়ে গিয়েছিল মানুষ গুলো। গাড়িতে উঠতে দেখি সবার চোখে জল, অজান্তেই আমার ও। ভালোবাসার টান অতি বড়।পথে বড় মসজিদ মাজার কবরস্থান পেড়িয়ে বড় রাস্তায় ফেরার পথে কাটোয়া পরাণ খাঁ র বিখ্যাত ল্যাংচা কিনে বিকেলের আলো গায়ে মেখে ফিরলাম এক ঝুড়ি ভালোবাসা পুঁটলি বেঁধে।