ছাগল--মানুষ  

 

সমর আচার্য্য 

 

তখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি। কলকাতা বীরেন্দ্র নাথ ইস্টিটিউশনে। আমাদের সেকশনের ক্লাস টিচার শ্রদ্ধেয় সুবোধ বাবু (নামটি কাল্পনিক, আসল নাম আর মনে নেই ) বেশ মজার লোক ছিলেন। বেশ কড়াও বটে। আমরা দুষ্টুমি করলে ডাস্টার ছুড়ে মারতেন। তাঁর বলা একটি গল্প আগে চললেও এখন আর শুনি না। গল্পটা এইরকম :----

 গ্রামের এক স্কুলে শিক্ষক মশাই রোজ ছাত্র পড়ায় , আর মাঝে মধ্যেই জোরে চিৎকার করে বলে ওঠে, তোদের নিয়ে আর পেরে উঠছি না। কত গাধা, ঘোড়া, ছাগল মানুষ করলাম, শুধু তোদের বেলায় হেরে যাবো? তা কোনমতেই হতে দেব না।তোদেরও মানুষ করেই ছাড়বো। 


ক্লাস ঘরের পুব পাশে গবাদী পশু চড়ানোর মাঠ। ক্লাস ঘরের জানালা দিয়ে তা দেখা যায়। সেই মাঠে রোজ এক বুড়ি একটা ছাগল নিয়ে ঘাস খাওয়াতে আসত। ক্লাসরুমের পাশে মাঠের ধারে কাঁঠাল গাছটার নিচে বসে বুড়িমা ছাগলের গতিবিধির উপর নজর রাখত। কালো কুচকুচে, নধর কান্তি ছাগ শিশুটি তার গলায় বাঁধা ঘন্টার শব্দে সারা মাঠ লাফিয়ে বেড়াত, আর খেলত, ঘাস খেত। বুড়ি আদর করে তার নাম রেখেছে সোনা। সোনা মাঝে মাঝেই বুড়ির কাছে ছুটে এসে একটু আদর খেয়ে যেত। মাস্টার মশাইও প্রতিদিন ঠিক একই ভাবে বলে চলত, কত গাধা, ঘোড়া, ছাগল মানুষ করলাম, আর তোদের করতে পারব না?


বুড়ির তো তিন কূলে আর কেউ নেই। ছাগল পুষেই তার সংসার চলে। অন্য ছাগল গুলো বেচে দিয়েছে। কিন্তু এই বাচ্চা ছাগলটার প্রতি খুব মায়া জন্মে যাওয়ায় তাকে আর বেচেনি। নিজের পুত্র তুল্য দেখভাল করে। 


রোজ জানালা দিয়ে মাস্টারের ঐ গাধা ঘোড়া গরু ছাগল মানুষ করার কথা শুনে শুনে তার মনে ইচ্ছে হয়, আহা রে, আমার এই সোনাকে যদি মানুষ করা যায় ! 


মাস্টারের কাছে গিয়ে বলে, ও মাস্টর, তুমি নাকি সব গাধা গরু ছাগল মানুষ করো। তা আমার এই সোনাকে একটু মানুষ করে দাও না। মাস্টার মশাই বলেন, নাগো বুড়িমা, ওটা কথার কথা!ঐ ছেলেরা সব পড়াশুনা ঠিকমতো করে না, তাই। কিন্তু বুড়ি জেদ ধরে, তার সোনাকে মানুষ করে দিতেই হবে। মাস্টারের বয়স কম। মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি আসে। বলে, ঠিক আছে, কাল সকালে আমার বাড়িতে ওকে দিয়ে এসো। হ্যাঁ, আর শোন, দুইদিন পরপরই কিন্তু খোঁজ নিতে এসো না। সব শর্ত মেনে বুড়ি তার প্রিয় সোনাকে মাস্টারের বাড়িতে রেখে আসে।


বেশ কিছুদিন অতিক্রান্ত। বুড়ির মন ছটফট করে পুত্র সম সোনার খোঁজ নিতে, তাকে দেখতে। মাস্টারের বাড়ি গিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে সোনাকে না দেখতে পেয়ে মনটা তার কেঁদে ওঠে। মাস্টারকে জিজ্ঞাসা করে, কৈ গো, আমার ছেলেটা কৈ। সে কি মানুষ হয়েছে। একবার আমাকে একটু দেখাও।

 

মাস্টার পড়ে মহা বিপদে। সে তো কয়দিন আগেই সোনাকে বেচে দিয়েছে। স্কুলে মাস্টারী করলেও তার মন ছিল কলুষিত। চট করে ভেবে নিয়ে বলে, তোমার সোনা তো এখন আদালতে গেছে। বুড়ি আশ্চর্য হয়ে বলে, কেন, আদালত কেন? সেখানে তার কি কাজ। মাস্টার বলে, সে এখন আলিপুর আদালতের উকিল।

 বুড়ি সাগ্রহে বলে, তা হলে আমার ছেলেটা মানুষ হয়েছে বলো? সে এখন ওকালতি করে! আমি তার সাথে দেখা করব।

 মাস্টার বলে, কোর্টে গিয়ে দেখবে গায়ে কালো কোট পরে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। থুতনিতে হালকা দাড়ি দেখবে, ছোটবেলায় যেমন মুখ নাড়িয়ে ঘাস খেত, এখনো ঠিক সেইভাবে পান চিবায়। প্রথমে তোমাকে চিনতে চাইবে না। কিন্তু তুমি তোমার দাবী ছাড়বে না।বুড়ি তো আনন্দে আত্মহারা হয়ে ছুটল কোর্টের দিকে। কোর্টে যেয়ে দেখে অনেক কালো কোট গায়ে দেওয়া উকিল। খুঁজতে খুঁজতে শেষে একজনের থুতনিতে হালকা দাড়ি দেখে তার কাছে গিয়ে তার গায়ে হাত বোলাতে থাকে। মুখে বলে, কী ভালো লাগছে রে তোকে সোনা। মাস্টার সত্যিই তোকে মানুষ করে দিয়েছে।

 

উকিলবাবু তো কিছুই বুঝতে পারে না। বলে, আপনি কাকে কি বলছেন? বুড়ি ওর থুতনির দাড়ি মৃদু নেড়ে দিয়ে বলে, ওরে তুই যে আমার সোনা ছাগল। তোকে কত আদর যত্ন করে ঘাস খাইয়ে, মাঠে চড়িয়ে পালন করেছি। মাস্টারের অশেষ দয়া সে তোকে মানুষ করে দিয়েছে। বুড়ির এমন আচরণে সবাই খুব মজা পেয়ে চারদিক থেকে তাকে ঘিরে ধরে বলে, কি হয়েছে, বুড়িমা বলোতো শুনি। তারপর বুড়ির মুখে সব শুনে সবাই তাজ্জব হয়ে যায়!কেউ বুড়িকে তিরস্কার করে, কেউ মুখ টিপে হেসে সরে পড়ে। বুড়ির সেই খুশিভরা মুখখানা দেখে উকিলবাবুর মন বিগলিত হয়ে যায়। মনে পড়ে নিজের মায়ের কথা। ভাবে, আহা রে এমন একটি অসহায় বৃদ্ধাকে নিয়ে এমন অসৎ আচরণ কেউ করতে পারে, তা যেন তার ভাবনার অতীত।পরে দেখতে হবে তো মাস্টার টাকে। বুড়ির কাছে এগিয়ে এসে বলে, হ্যাঁ হ্যাঁ, আমিই তোমার সেই সোনা। আজ থেকে তুমি আমার সাথে আমার বাড়িতেই থাকবে। বুড়ির চোখে মুখে স্বর্গীয় খুশির ঝিলিক। তার সোনার হাতটি ধরে বলে, চল বাবা তাই চল। তারপর সেই মাস্টারের উদ্দেশ্যে মাথায় হাত তুলে প্রণাম করার মতো করে মনে মনে বলে, তুমি সত্যিই আমার সোনা ছাগলটাকে মানুষ করে দিলে!