অপরিণামদর্শী
তমাল রায়
রুদ্র ছোটোবেলায় খুব চঞ্চল ও দুষ্টু ছিলো। তার দুষ্টুমিতে অতিষ্ঠ হয়ে তার ঠাকুরদা বাড়ির পাশের সরকারি স্কুলে নিয়ে গিয়েছিল ভর্তি করাতে। সালটা 1990 সাল। প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে তার ঠাকুরদার ভালো পরিচয় ছিলো। ঠাকুরদা গিয়ে প্রধান শিক্ষককে বললেন মাস্টার মশাই আমার নাতিকে আপনার স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিন।
মাস্টার মশাই রুদ্রের বার্থ সার্টিফিকেট দেখে বললেন ওর বয়স তো 4 বছর 3 মাস এবং পাচ বছরের আগে ভর্তি করা সম্ভব নয়।
ঠাকুরদা একটু ভেবে বললেন ঠিক আছে আমার নাতির বয়স পাচ বছর হলে তখন ভর্তি করিয়ে দিবেন। কিন্তু এখন আপনার স্কুলে যাতায়াত করতে থাক।
মাস্টার মশাই বললেন ঠিক আছে।আসলে তখন এখনকার মতো এতো কড়াকড়ি ছিলোনা এবং ভর্তির বয়স ছয়ের বদলে পাচ বছর ছিলো।
যাইহোক এভাবে রুদ্র স্কুলে যাতায়াত করতে করতে হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা দিতে গেলো। তখন এখনকার মতো সেমিস্টার ভিত্তিক ছিলোনা। যাইহোক প্রথম দিন বাংলা পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে আসার পর তার বাবা জিজ্ঞাসা করল পরীক্ষায় কি কি প্রশ্ন এসেছে?
রুদ্র একটা প্রশ্নের কথা বলাতেই তার বাবা জিজ্ঞাসা করল এর উত্তর কি লিখেছিস?
রুদ্র তখন বলল কিছু লিখিনি।
তার বাবা বলল কেনো লিখিসনি?
রুদ্র উত্তরে বলল এটা তো আমি জানি তাই লিখিনি। এভাবে যে প্রশ্নের কথাই বলা হয় সব প্রশ্নের সে একই উত্তর দেয়। তার বাবা প্রচন্ড রেগে যায় এবং লাঠি দিয়ে মারতে শুরু করে। জীবনের প্রথম পরীক্ষায় যদি কারো সন্তান যদি জেনেও না লিখে তাহলে তার বাবা মায়ের রাগ করাটা স্বাভাবিক। যাইহোক পরের পরীক্ষায় তার বাবা তার ঠাকুরদাকে পাঠিয়ে দেয় স্কুলে এবং বলেন মাস্টার মশাইকে একটু গাইড করার জন্য। বাকী পরীক্ষাগুলো ভালো দিয়েছিলো। এভাবে ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে ক্লাস টুতে উঠে গেলো। ক্লাস টুতে উঠার পর তার বন্ধু সুজনের সঙ্গে আবার ক্লাস ওয়ানেই বসেছিলো। তখন স্কুলের এক দিদিমনি বলল রুদ্র তুমি ক্লাস টুতে উঠেছো তুমি ওই ঘরে গিয়ে বসো। কিন্তু রুদ্র কিছুতেই যেতে চাইছিলোনা কারণ তার বন্ধু সুজন বড়ো ওয়ানে উঠেছে আর রুদ্র টুতে উঠেছে। রুদ্র দিদিমনিকে বলল সুজন
বড়ো ওয়ানে উঠেছে আর সে কি করে টুতে উঠে? রুদ্র তো জানতইনা কোনো ছাত্র ফেল করলে তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলা হতো সেই ছাত্র বড়ো ওয়ানে উঠেছে।
যাইহোক মাস্টার মশাই দিদিমনিরা বোঝানোর পর সে ক্লাস টুতে গিয়ে বসতে রাজি হয়েছিল। তার পাচ বছর পূর্ণ হওয়ার পর ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করার কথা ছিলো সেটা আর করতে হলোনা। পড়াশোনায় ভালো হওয়া সত্বেও সে ঠিকঠাক পড়াশোনা করতনা বলে রেজাল্ট ভালো হতোনা।
একদিন প্রাইভেট টিচার পড়া না পারার জন্য লাঠি দিয়ে মেরেছিলো তাকে এবং তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলো তোর পড়তে ইচ্ছে করেনা। তখন সে বলেছিলো না তার পড়তে ইচ্ছা করেনা। এই কথা তার মা বাবাকে জানানোর পর সেদিন খুব মেরেছিলো তার বাবা। যাইহোক পরে আর সে আর সেই কথা কোনো দিন বলেনি এবং ঠিকঠাক পড়াশোনা করত। কিন্তু
বর্তমানে বাচ্চাদের যদি এই প্রশ্ন করা হয় তোর পড়াশোনা করতে ইচ্ছা করেনা। বাচ্চারা তার উত্তরে যদি ওই একই কথা বলে না পড়তে ইচ্ছা করেনা তাহলে সেই বাচ্চার অভিভাবকরা খুশীতে আত্মহারা হয়ে যান ।
রুদ্রের আসল নাম অমিতাভ দে। তার বাবা অলোক দে, মা সুমিত্রা দে এবং দিদি অনন্যা দে।
রুদ্রের পড়াশোনা করার চেয়ে খেলাধুলা করার বেশি নেশা ছিলো। তার মা স্কুল ছুটির পর দুপুরে তাকে খাইয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করত। কিন্তু সে কিছুতেই ঘুমাতে চাইতনা। বিকেলে খেলাধুলা করে সে খুব ক্লান্ত হয়ে যেতো। তার মা পড়াতে বসালে তার চোখে যত রাজ্যের ঘুম চলে আসত। তার মা যতক্ষণ সামনে থাকত ততক্ষণ কষ্টে পড়াশোনা করত। যখনই রান্না করতে চলে যেতেন তখন আস্তে আস্তে কাত হয়ে শুয়ে বই পড়তে পড়তে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ত। তার মা রান্না ঘর থেকে
যদি চিৎকার করে বলত কিরে তোর পড়ার আওয়াজ পাওয়া যায়না কেনো। যদি তার কানে ঠিকঠাক আওয়াজ যেতো তখন সে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে উুঞ উুঞ করতে থাকত।
একদিন রাতে তার বাবা রুদ্রকে খাওয়ার সময় তার মাকে বলল কাল থেকে আর ওর পড়াশোনা করতে হবেনা, স্কুলে যেতে হবেনা। ওকে চায়ের দোকানে ঢুকিয়ে দিবো। ও চায়ের বাসন মাজবে ওটাই ওর জন্য ঠিক আছে। ওর দ্বারা পড়াশোনা হবেনা।
রুদ্র কাঁদতে কাঁদতে তার মাকে বলল মা বাবাকে বলো সে কাল থেকে আর সন্ধ্যায় ঘুমাবেনা এবং মন দিয়ে পড়াশোনা করবে। চায়ের দোকানে ঢোকাতে না করো বাবাকে। তার মা বলল তুই বল স্কুল থেকে আসার পর খেয়ে দেয়ে ঘুমাবি এবং সন্ধ্যায় পড়তে বসে ঘুমাবিনা।
রুদ্র বলেছিল ঠিক আছে মা, আর কোনোদিন ঘুমাবোনা। এভাবে কিছুদিন চলার পর আবার আগের মতো পড়তে বসে ঘুমিয়ে পড়ত। এই চায়ের দোকানে কাজে ঢোকানোর হুমকি পরেও দিতেন। কিন্তু কিছুদিন ঠিক থাকার আবার আগের মতোই হয়ে যেতো। তারপর তার বাবা সিদ্ধান্ত নিলো রাতে দুই ভাই বোনের জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসবে। যে জেগে থাকবে একমাএ সেই খেতে পাবে। এরপর থেকে খাওয়ার লোভে রুদ্রের সন্ধ্যায় পড়তে বসে ঘুমানো কমে গিয়েছিল। ক্লাস নাইনে উঠার পর রুদ্র তার মায়ের কাছে বায়না করল টিভি কেনার জন্য। যথারীতি একটা ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট টিভি কিনলো। তারপর থেকে টিভি দেখার নেশা বেড়ে গিয়েছিল। শুক্রবার, শনিবার তো অনেক রাত পর্যন্ত টিভি দেখত দুরদর্শনে সিনেমা দেখার জন্য। এই টিভি দেখার জন্য তার পড়াশোনাতে আবারও ব্যাঘাত ঘটেছিল। জীবনের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা
মাধ্যমিকও অবহেলা করে দিয়েছিলো। জীবন বিজ্ঞান পরীক্ষার আগের রাতে চিতাবাঘ বেরিয়েছিলো সেটা দেখতে চলে গিয়েছিল। অঙ্ক পরীক্ষার আগের রাতে হাতি বেরিয়েছিলো সেটা তাড়াতে চলে গিয়েছিল। মাধ্যমিক পরীক্ষা ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে হোলি উৎসবে সকল ছাত্রছাত্রী হোলি খেলেনা। কিন্তু সেও খেলেছিলো। যাইহোক সে মাধ্যমিক 47 % নম্বর পেয়ে সেকেন্ড ডিভিশনে পাশ করেছিল। মাধ্যমিকের রেজাল্টের ভিত্তিতে আর্টস নিয়ে পড়া ছাড়া তার কাছে কোনো উপায় ছিলোনা। সে উচ্চ মাধ্যমিকে সেকেন্ড ডিভিশনে 52% নিয়ে পাশ করলেও সে কোনো সাবজেক্টে অনার্স পায়নি। আসলে সে তার বন্ধুবান্ধবের চক্করে পড়ে শিলিগুড়ি কলেজ ছাড়া অন্য কলেজে ভর্তি হয়নি। সে অন্য কলেজে ভর্তি হলে সে অনায়াসে অনার্স পেয়ে যেতো। অনার্স
না পাওয়ায় তার পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ কমে গিয়েছিল। সে 41% নিয়ে কোনো রকম স্নাতক শেষ করে। স্নাতক শেষ করার পর চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিল কিন্তু তাতেও সে সফল হয়নি। তার পরিবারের আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ার জন্য চাকরির পরীক্ষা দেওয়া কনটিনিউ করা সম্ভব হচ্ছিলোনা। যখন তার মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছিল সে একটা ঔষধের ফার্মেসিতে কাজে ঢুকে গিয়েছিল। পরবর্তীতে সে ঔষধের ফার্মেসির কাজ শিখে লাইসেন্স ভাড়া করে নিজের একটা ছোটো ফার্মেসি খুলে ছিলো এবং ফার্মেসিই তার পেশা হয়ে দাড়ালো। তার ফার্মেসিতে কাজ করতে করতে প্রচুর অভিজ্ঞতা হয়ে গেলো। রোগীর সঙ্গে কথা বলে রোগ নির্ণয় করে সঠিক ঔষধ দিয়ে অনেক রোগীর মন জয় করা এবং কাস্টোমারের সংখ্যা অনেক বেড়ে গিয়েছে। তার কাছে প্রচুর অভিজ্ঞতা রয়েছে কিন্তু সার্টিফিকেট নেই। সেইজন্য তার রোগী দেখে রোগ নির্ণয় করে ঔষধ প্রেসক্রাইব করার অধিকার নেই। তার
যদি ডাক্তারি পাশ করার সার্টিফিকেট থাকত তাহলে হয়তো সে অনেক বড়ো নামকরা ডাক্তার হতে পারত। তার জীবনে একটাই আফশোস কেনো সে পড়াশোনা মনোযোগ দিয়ে পড়েনি।
রুদ্রের মাঝেমধ্যে ছোটোবেলার কথা ভেবে খুব কষ্ট পায়। তার মনের মধ্যে কিছু কথা ঘোরপাক খায়। যখন সে সকালে পড়তে বসত তখন জানলা দিয়ে যেই যেতো তাদের দেখত এবং তাদের নিয়ে ভাবা শুরু করে দিতো। ভাঙাচুড়া কুড়ানি বাচ্চা দেখলে তখন তার মনের মধ্যে ভাবনা শুরু হয়ে যেতো। ওরা কতো সুখী, ওদের পড়াশোনা করতে হয়না। পাড়ার কাকু, কাকি, জ্যাঠু, দাদু যেই যাকনা কেনো তাদের নিয়ে তার একটাই ভাবনা তারা কতো সুখী তাদের পড়াশোনা করতে হয়না। এখন সেই ভাবনা নিয়ে একটাই দুঃখ কেনো সে মন দিয়ে পড়াশোনা করেনি। সে যদি মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করত তাহলে তার বড়ো নামীদামি ডাক্তার হওয়ার সুযোগ থাকত।
বর্তমান প্রজন্মের বাচ্চাদের মাঠে ঘাটে খেলার প্রবণতা না থাকলেও মোবাইল নিয়ে সবসময় পড়ে থাকে। তাদের মোবাইল ছাড়া এক মুহূর্ত চলেনা। আধুনিক যুগে মোবাইল কম্পিউটার ব্যবহার অপরিহার্য কিন্তু আসক্ত হয়ে পড়াশোনার ক্ষতি করা উচিৎ নয়। অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারের ফলে বাচ্চাদের মধ্যে চোখের দৃষ্টিশক্তির সমস্যা বেশি পরিমাণে দেখা যাচ্ছে।
কাজেই প্রত্যেক বাচ্চাদের এই বিষয়টি ভেবে দেখা উচিত। বাচ্চাদের পড়াশোনা করার ইচ্ছা থাকেনা। তাদের ইচ্ছাশক্তি বাড়াতে হবে তার অভিভাবকদেরই। পড়াশোনা করে বড়ো চাকরি পেলে তাদের ভবিষ্যত সুখকর হয়ে উঠবে নইলে কোনো রকম কাজ করে কষ্টে জীবনযাপন অতিবাহিত করতে হবে। টাকা ছাড়া কোনো সখ আল্লাদ পুরণ করা সম্ভব নয়। তাই অভিভাবকদের উচিৎ তাদের সন্তানদের ভবিষ্যত নিয়ে সঠিক পরামর্শ দেওয়া এবং
দরকার পড়লে জোর করে পড়তে বাধ্য করা। কারণ কোনো যোগ্য বাচ্চার পড়াশোনার প্রতি অবহেলার জন্য সে নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী সফলতা পায়না। বাচ্চাদের এই মানসিকতার জন্য অনেক মেধাবী ছাত্র জীবনে সফলতা পায়না। তাই প্রতিটি অভিভাবকদের তার সন্তানের প্রতি অনেক বেশি যত্নবান হতে হবে। তাই বলে এটা নয় যে সব বাবা মায়ের তাদের সন্তানকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার তৈরী করাই একমাএ উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ। সন্তানের ইচ্ছাশক্তি ও পারদর্শীতা বিবেচনা করেই সঠিক পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করা।