মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়
মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়
রম্যরচনা
পাত্রী দেখা
সকাল দশটা দশের শিয়ালদহ শান্তিপুর আপ লোকালের লেডিস কম্পার্টমেন্টের ঠিক পরের জেনারেল বগিতে চলন্ত গাড়ির ভেতরে হঠাৎ করেই দুই দাড়িয়ে থাকা যাত্রীর মধ্যে কথা নেই বার্তা নেই রীতিমতো হাতাহাতি শুরু হয়ে গেল। উপস্থিত সবাই তো হই হই করে উঠলো। একজনের বয়স বছর কুড়ি কি বাইশ, আর আরেকজনের তা হবে প্রায় পঞ্চান্নর কাছাকাছি। ট্রেন সবে মদনপুর ছেড়েছে।পাশের লোকটি বললো, “এদের সাথেই তো আমি মিনিট বারো আগেই একসাথে কল্যানী স্টেশন থেকে উঠলাম। এইটুকু সময়ের মধ্যেই কি এমন হয়ে গেলো যে একজন বাপের বয়সি ভদ্রলোকের সাথে একজন ছেলের বয়সি ছোকরার মারপিট লেগে গেল!” উপস্থিত সবাই দুজনকে অনেক কষ্টে ছাড়িয়ে আলাদা করে বয়স্ক ভদ্রলোকটিকে একজন ইয়ং ছেলেকে সিট থেকে উঠিয়ে বসতে দিলেন। ভদ্রলোকের গালে দু-এক জায়গায় নখের আঁচড়ে সৃষ্ট ক্ষতের সুস্পষ্ট চিহ্ন।
সবাই তো ছেলেটিকে রীতিমতো যার যা মনে আসছে বলতে শুরু করলো। “তুমি কেমন ছেলে হে ছোকরা, একজন বাপের বয়সি মানুষকে এইভাবে আঘাত করে? তোমার প্রাণে কি কোনও দয়া মায়া বলে বস্তু নেই? তুমি কি মানুষ নাকি জন্তু?”
“আজকালকার ইয়ং জেনারেশনের কথা আর বলবেন না দাদা। বাড়িতে নিজের বাবাকেই ঠিকমতো সন্মান দিতে পারেনা, তো এরা দেবে অন্য বাপের বয়সি লোকেদের সন্মান!!”
“যা বলেছেন। আরে আমরা তো এখনো বাপ,কাকাকে আপনি আজ্ঞে করে সন্মান করে কথা বলি। আর এদেরও দেখুন। এই যদি আধুনিক সভ্যতার ছিড়ি হয় তাহলে পাঁচ-দশ বছর বাদে কি যুগ আসতে চলেছে বুঝতে পারছেন? মায়ের পেট থেকে বেড়িয়ে এসেই হয়তো ডাক্তার বাবুর কাছ থেকে সিগারেট চাইবে।“
“যা বলেছেন, একদম খাঁটি কথা। কলি যুগের অবসান হয়ে নাকি কল্কি অবতার জন্মাবেন।“
“আর ছেলে ছোকরার দল সব কল্কেতে দম দিয়ে শ্মশান বাসী বাবা ভোলেনাথের মতো রক্তচক্ষু করে বাবা-মায়ের বুকে ত্রিশুল ঠেকিয়ে শিব তান্ডপ দেখাবে।“
চলন্ত কামরার ভেতরে সবাই এতো ট্যাঁরা ব্যাঁকা কথা বলছে, মজা করছে, হাসতে হাসতে এ, ওর গায়ে ঢলে পরছে অথচ যাদের আচরণের জন্য এত উত্তেজনা তারা দুজনেই কেমন নির্লিপ্ত হয়ে একদম চুপ। দুজনার কেউই আর টু-শব্দটি করছে না। যেন এত হাসি ঠাট্টা ওদের কানেই ঢুকছে না। একজন সহানুভূতিশীল অল্প বয়সি মহিলা তার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে একটি ছোট আধুনিক জলের বোতল বের করে বসে থাকা বয়স্ক ব্যক্তিটির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ”আপনার খুব ব্যথা লেগেছে তাইনা দাদা? আপনার ওপরে এইভাবে চড়াও হয়ে আপনাকে আঘাত করে নখের আঁচড়ে রক্তাক্ত করে দিল, আর আপনি এইভাবে চুপ করে সবকিছু সহ্য করে নেবেন? আপনার তো থানায় গিয়ে এই অসভ্য ছেলেটির বিরুদ্ধে নালিশ করা উচিত। ও আপনার সাথে আজ যা করেছে তার জন্যে ওর একটা কঠোর শাস্তি পাওয়া উচিত। অথচ আপনি একটুও প্রতিবাদ না করে সবকিছু নীরবে সহ্য করে নিচ্ছেন?”
একজন বছর চল্লিশের ভদ্রলোক পাশ থেকে বলে উঠলেন, “আরে ম্যাডাম, সব বাবারই এরকমই হয়। আসলে আমার মনে হয় ওনার বাড়িতে ওনারও এই বয়সেরই কোনো ছেলে সন্তান আছে। আর তার কথা ভেবেই উনি হয়তো চাইছেন না যে এই ছেলেটির কোনও ক্ষতি হোক। আপনারা মহিলারা বাবাদের মনের এই ফিলিংসটা বুঝবেন না।“
“কিন্তু তাই বলে এতো বড় একটা অন্যায় করে একজন ছাড় পেয়ে যাবে? অন্যায় করলে সে শাস্তি পাবেনা? ক্ষমা করারও তো একটা সীমা থাকবে!! আর এইভাবে চলতে থাকলে একদিন এই ছেলে গুলোই তো এক একটা ক্রিমিনাল-এ পরিণত হবে। ধরেই নেবে দেশে আইন বলে কিছুই নেই। ফলে যখন যাকে মারধর করার ইচ্ছে হবে মেরে দেবে। প্রয়োজনে মেরেও ফেলতে পারে। আর আপনারা, মানে আপনাদের মতো সো কল্ড সহানুভূতিশীল বাবারা সেটাকে মুখ বুজে হজম করবেন? না, এই অন্যায় কিছুতেই মেনে নেওয়া যায়না। আচ্ছা দেখুনতো মনে হয় শিমুরালি স্টেশন এসে গেছে। দাদা উঠুন, প্লিজ। এইভাবে নির্লিপ্ত হয়ে চুপ করে বসে থাকবেন না। প্রত্যেকটা অন্যায়-এর প্রতিবাদ হওয়া দরকার। নাহলে আমাদের দেশ তো ক্রিমিনাল-এ ভরে যাবে। এদের ভয়ে সাধারণ মানুষ ভবিষ্যতে নিজের বাড়ির বাইরেই বেরোতে পারবে না”। বলে উঠলেন ভদ্রমহিলা।
আশপাশ থেকে আরও চার পাঁচ জন একসাথে মহিলাকে সমর্থন করলেন। “হ্যা, উনি একদম ঠিক কথা বলেছেন। ছেলের বয়সিই হোক বা যেই হোক অন্যায় করলে শাস্তি সবাইকেই পেতে হবে। এই ছেলেটিকে এখনি চলুন সবাই মিলে রেল পুলিশের হাতে তুলে দি। দাদা, ম্যাডাম ঠিকই বলেছেন। চুপ করে হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন না। প্রত্যেকটি অন্যায়ের প্রতিবাদ হওয়া দরকার। আর আপনি সাথে না গেলে তো পুলিশ ছেলেটির বিরুদ্ধে এফ আই আর জমাই নেবে না। ওনাদের কাছে প্রমাণ দেখাবো কি করে যে এই ছেলেটি আপনার মত নিরীহ একজন বয়স্ক মানুষকে অকারণে এইভাবে মারধর করে আহত করে রক্তারক্তি করে দিয়েছে।“
“আরে, না না, ছেড়ে দিন না। যা হওয়ার হয়ে গেছে। ছেলেটিও নিশ্চই এতক্ষণে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। তাইতো দেখছেন না কোনও কথা বলছে না। কেমন চুপ করে গেছে।“ আহত ভ্রদ্রলোকটি অতি কষ্টে মুখ বেঁকিয়ে বলে উঠলেন।
“না, আমি মোটেও নিজের ভুল বুঝতে চাইনা । আর ভুল বোঝার তো কোনও জায়গাই নেই। অন্যায় করলে তুমি আর আমি তার জন্যে তখন থেকে চুপ করে মুখ বুজে কামরার প্রায় সব লোকেদের মুখ থেকে নোংরা গালিগালাজ শুনছি। এই ভদ্রমহিলা তো পারলে আমাকে ফাঁসির মঞ্চেই তুলে দেন। আজ তুমি বাড়ি চলো, তোমার হবে। আজ থেকে বাড়িতে হয় তুমি থাকবে নয়তো আমি। অবশ্য বাড়ি তো তোমার নামে আছে। সুতরাং তুমিই ঐ মেয়ের বয়সি মেয়েটাকে বিয়ে করে নিজের বাড়িতেই থেকো, আমিই বেড়িয়ে যাবো। খুব বিয়ে করার সখ হয়েছে না এই বয়সে? চলো কার বিয়ে কে দেয় সেটা আমিও দেখাচ্ছি। ছেলের বিয়ে দেবে বলে মেয়ে দেখতে গিয়ে সেই মেয়েকে নিজের জন্য পছন্দ করে পাঁকা কথা দিয়ে চলে এলে!! তোমার শরীরে এক বিন্দু লাজলজ্জা বলে কিছু থাকতে নেই ? তুমি কি বাপ নাকি ছেলের শত্রু??”
পাশ থেকে কে যেন বলে উঠলো, “ও দাদা, এ তো কেস দেখছি জন্ডিস। কথা বার্তা শুনে তো আপন বাপ বেটা বলেই মনে হচ্ছে। খেলা এবার জমে যাবে।“
“তার মানে!!” সেই অল্প বয়সি মহিলাটি তো মনে হলো যেন একেবারে আকাশ থেকে পরলেন। “কি বলছো ভাই, এই ভদ্রলোক তোমার নিজের বাবা?”
যে সব সহযাত্রীরা এতক্ষণ ছেলেটিকে রেল পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার জন্যে আহত ভদ্রলোকটিকে উৎসাহিত করছিলেন, তারা এবার পুরো একশ আশি ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে সমস্বরে ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, “হ্যা ভাই বলতো, আসল কেসটা কি? এতো মনে হচ্ছে বিশাল একটা গড়বড় কেস। শুনতে হচ্ছে দেখছি। একটু প্রথম থেকে খুলে বলতো। ভদ্রলোকটিকে দেখে তো মনে হচ্ছে ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানেন না।“
“ঐ জন্যেই দেখছেন না, এতক্ষণ ধরে কেমন ভিজে বেড়ালের মতো গুটিয়ে বসে আছে। না শাস্তি দিতে হবেনা। না ছেড়ে দিন, ছেলেটি এতক্ষণে নিশ্চই নিজের দোষ বুঝতে পেরেছে। যেন কলির যীশুখৃষ্ট !!“
“আরে, জানে তো, বেশি খোঁচাখুঁচি করলে আসল সত্যটা ঝুলির ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়বে। আর ওনার মহৎ চরিত্রের গুণ কীর্তন সবাই আমরা জেনে যাবো।“
“হ্যা ভাই, তুমি আমাদের বলো তো আসল রহস্যটা কি? ওনার স্ত্রী মানে তোমার মা কি এখনো বেঁচে আছেন, নাকি গত হয়েছেন?”
“আমার মা সবে আড়াই মাসও হয়নি গত হয়েছেন। বাড়িতে মেয়ে মানুষ বলতে একমাত্র প্রায় পঁচাত্তরের কাছাকাছি ঠাকুমা। মা-ই সংসারের পুরো হালটা ধরে রেখেছিলেন। ফলে মায়ের অবর্তমানে বাড়িতে খুবই বিশৃঙ্খল অবস্থা চলছে। বিশেষ করে খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারটা খুবই বিঘ্নিত হচ্ছে। আমাদের গ্রামে প্রথমত কারোর বাড়িতেই রান্নার লোক রাখার চল নেই। আর যেহেতু বাড়িতে দু-দুটো উঠতি পুরুষ মানুষ আছে, ফলে কেউ রাজীও হবেনা। তাই ঠাকুমা বললো যে পলাশের, মানে আমারই, একটা ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে দিয়ে বাড়িতে নাত বৌ নিয়ে আসার জন্যে। দেখতে শুনতে যাই হোক ঘর গৃহস্থালির কাজ জানা বছর আঠারো কুড়ির ভালো পরিবারের মেয়ে হলেই চলবে। তাই আমরা বাপ বেটা দুজনে কল্যাণীর কাছেই গয়েশপুরে একজনের বাড়িতে আমার জন্যে মেয়ে দেখতে গিয়েছিলাম। কিন্তু বাবা সেখানে যা ঘটনা ঘটালো সেটা আমার কল্পনারও অতীত ছিল। আমরা যখন মেয়েটির বাড়িতে পৌঁছলাম তখন মেয়েটি স্নান করে বাড়ির ছাদে দাড়িয়ে রোদে চুল শোকাচ্ছিল। আমার মতো বাবাও নিশ্চই সেই দৃশ্য দেখেছেন, আর....।“
“বুঝে গেছি, আর বলতে হবেনা। পুরো কেসটা একেবারে জলের মতো পরিস্কার।“ একজন অতি উৎসাহি আর থাকতে না পেরে বলে উঠলেন।
“এবং মনে মনে সেই মেয়ের বয়সি কচি মেয়েটিকে দেখে তার প্রেমে হাবুডুবু খেতে শুরু করে দিলেন তোমার পিতৃদেব।“ আরেকজন বাজনদার এবার সঙ্গত ধরলেন।
“এবং নিজেকেই পাত্র হিসেবে উপস্থাপিত করে স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির হিসেবটি পাত্রীর বাবার কাছে নিবেদন পূর্বক মেয়েটিকে নিজের পক্ষে টেনে নিলেন। ভেরি সিম্পল“ সানাই বাদক বলে উঠলেন।
“এবং, ঐ যায়গায় আপনারা যে কোনও একজন পুরুষ থাকলেই এই একই কাজ করতেন। অ্যাম আই রাইট? ইয়েস আই অ্যাম হান্ড্রেড পার্শেন্ট রাইট। আপনাদের প্রত্যেকটি পুরুষকেই আমার হাড়ে হাড়ে চেনা হয়ে গেছে। আমার বাড়িরটিও তো একইরকম। মরলেই আবার দৌড়বে বিয়ে করতে।“ ঝাঁঝিয়ে উঠলেন উপস্থিত সেই মহিলাটি।
“ও কাকু তাহলে আমার কি হবে?” প্রায় কাঁদো কাঁদো সুরে ভিজে গলায় কঁকিয়ে উঠলো ভাইপো ছেলেটি।
একজন পায়রাডাঙা স্টেশনে কামরা থেকে নামতে নামতে বলে গেলেন, “আপাতত নতুন মায়ের হাতের দুধ ভাত খাও। পরে বয়স পাকলে নাহয় মাংস ভাত খেও”