সুতপা ব্যানার্জী(রায়)
সুতপা ব্যানার্জী(রায়)
বনপলাশি
তৃতীয় বর্ষ,উৎসব সংখ্যা ২০২৩-২০২৪
মূল্য-২০০টাকা
বনপলাশির উৎসব সংখ্যা হাতে নিয়ে মনে হল সাহিত্যের পান্না চূণীদের পেয়ে গেলাম। শৈলবালা ঘোষজায়ার জীবনকথা পড়ে মনে হল আশাপূর্ণা দেবীর মতো ঘরের কোণে অক্ষর সৃষ্টির এমন মণিমুক্তো অকল্পনীয়। ওঁর বৈধব্যের যন্ত্রণার দিনগুলো এমন সৃষ্টি পথে সঞ্চারিত হওয়া,সৃষ্টির ছত্রে ছত্রে গোঁড়ামির মূলে এমন কুটারাঘাত। নিজের জীবনকে স্বাধীন চিন্তার পথে চালিত করা,এ যদি আধুনিকতা না হয়,তাহলে আধুনিকতা কী? 'কর্পূরের মালা' পড়তে গিয়ে সাধুভাষার সাধু সঙ্গ একটুও বিচলিত করে না।বরং ঘটনার অভিঘাত শেষ অব্দি টেনে রাখে। জীবনের রহস্যময়তা গল্পের পরতে পরতে। ছড়িদার রঞ্জনের এমন নিরুচ্চার প্রেম যে এক ব্রাহ্মণের শুভেচ্ছায় পরিণত হবে তা ভাবা যায় না। ছবির জন্য রঞ্জনের মনের দোলাচল ও শেষের অনুভূতি পাঠক মনে এক উজ্জ্বল ছবি এঁকে রাখার মতো। শ্রদ্ধেয়া লেখিকার সব লেখা পড়ার ইচ্ছে রইল যা পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। জ্যোতির্ময়ী দেবীর লেখা 'একটা প্রকাণ্ড হাঁ' পড়ে বিস্মিত হলাম। জাতের নামে বজ্জাতির ধ্বংসাবশেষের ওপর ঠিক নির্মিত হয় অমল ও নীতির ঘর বাঁধার স্বপ্ন। সুলেখিকা সুলেখা সান্যালের 'বিবর্তন' গল্প এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের তিনটে চরিত্র নিয়ে আবর্তিত হয়। চাকরি হারানো অভয়ের পারিবারিক দুর্দশার বর্ণনার সঙ্গে হয়ত আমরা পরিচিত। তবে সে দুর্দশা যখন এক উঠোন বারো ঘরে এসে পল্লবিত হয় তখন তা একটা অচেনা গল্প হয়ে সামাজিক বার্তা রেখে যায়। শ্রী সাধন চ্যাটার্জীর পর্যালোচনায় সুলেখা সান্যালের সাহিত্য কর্মের অভিনবত্বের বিষয়ে জানলাম। পোশাক পরিচ্ছদের আধুনিকতা ছাড়াই প্রকৃত আধুনিক ভাবনা কাকে বলে তা আমরা ওঁর লেখায় পাই। দেশের স্বাধীনতার আগের সমকালীন সময়ে তিনি যে ভাবে নিজের স্বাধীন চিন্তাকে পোষণ করেছেন তা এককথায় অতুলনীয়। মাত্র চৌত্রিশ বছরের জীবনে একটা চেনা গতের জীবনের বাইরে তিনি অনন্যা হতে পেরেছিলেন।
লেখিকা সাবিত্রী রায়ের গল্প 'স্বর্গ হইতে বিদায়' থেকে দেশভাগের সংকটের যেমন উল্লেখ আছে সেরকম অন্যের সংসারকে আপন করে নিলেও উপেক্ষার যন্ত্রণা আছে। তবে গল্পের শেষে নিরালা নির্জন বাড়িতে সন্ধ্যাবাতি দেওয়ার মতো ঘটনা সব হিসেবকে পালটে দেয়। নিজের জীবন আচরণেও লেখিকা ছিলেন স্পষ্ট, চাঁচাছোলা। কোন দ্বিচারিতাকে প্রশ্রয় দেওয়া ওঁর স্বভাববিরুদ্ধ ছিল। সোমা সেনের কলমে সেই নির্ভীক,সময়ের তুলনায় এগিয়ে থাকা সাবিত্রী রায়কে আবিষ্কার করি। সম্পূর্ণা দেবী রচিত 'অমীমাংসিত' গল্পে বাবা'ছেলের ধর্ম সংকটের চিহ্ন এঁকেছেন যেখানে ভবিতব্য আলাদা হচ্ছে। কোথাও ধর্ম রক্ষার দায় বড় হচ্ছে আবার কোথাও মনুষ্যত্বের দায় ভারী হচ্ছে। তাই ছেলের উদ্দেশ্যে ভর্ৎসনা করেও বাবার মনে হৃদয়ধর্মের রেশ থেকে যায়। সাধু ভাষায় লেখা হলেও ঘটনার গাঁথনিতে,পড়ার আগ্রহে কোন ছন্দপতন হয় না।
শ্রদ্ধেয়া লেখিকা সম্পূর্ণা দেবীর জীবন ও সাহিত্য নিয়ে লেখিকা দোলনচাঁপার লেখা 'হল না তার ফুটে ওঠা' এ পত্রিকার শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এই পর্যালোচনা শুরু থেকে শেষ অব্দি একটানা পড়েছি ও মুগ্ধ হয়েছি। শ্রদ্ধেয়া সম্পূর্ণা দেবীর ডাক নামের মাধ্যমে লেখাটা চালিয়ে বাউন্ডারি হাঁকানোর মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। মাইকেল মধুসূদনের জন্মের দ্বিশতবর্ষের শ্রদ্ধার্ঘ, শুভজিৎ সরকার রচিত 'পুরুলিয়ার মধুসূদন' থেকে চিরস্মরণীয় মধুকবির জীবনের অনেক অজানা দিক সম্পর্কে জানতে পারলাম। বিদ্যাসাগরের কারমাটাড়ের মতো মধুকবির জীবনের শেষ আশ্রয় ছিল পুরুলিয়ার কাশীপুর। রাজা নীলমণির আহ্বানে স্টেটের ব্যারিস্টার হিসেবে মধুকবি ওখানে যান।
তবে চরম অপমানের মধ্যে দিয়ে কর্মচ্যূত হয়ে জীবনের শেষ আশ্রয়ও তাঁকে ছেড়ে আসতে হয়। তাই মধুকবির ঐ সময়ের রচনায় স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ দুইয়েরই অস্তিত্ব পাওয়া যায়। শ্রী বিশ্বরূপ মণ্ডল রচিত প্রবন্ধ 'মেঘনাদবধ কাব্যের মহাকাব্যত্ব বিচার'এক উচ্চমার্গের লেখা। যেখানে যুক্তি সহযোগে হোমারের মহাকাব্যের সঙ্গে 'মেঘনাদবধ কাব্যে'র তুলনা করা হয়েছে। বিষয়বস্তু, বর্ণনা ও অমিত্রাক্ষর ছন্দে যা আমাদের প্রচলিত কাব্য অনুভূতিকে পুরো পালটে দিয়েছিল। তথ্যবহুল ঐ সমস্ত যুক্তি হাজির করে লেখক এক আশ্চর্য মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। পরবর্তী রচনা বিমলকুমার শীটের 'পঞ্চকোটের রাজা নীলমণি সিংহদেওর আইন-উপদেষ্টা মাইকেল মধুসূদন দত্ত'-থেকে মধুকবির জীবনের পুরুলিয়া পর্বের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা পেলাম। আইন পেশার মারপ্যাঁচ কল্পনা প্রবণ কবি জীবনের শেষপর্যন্তও বুঝতে পারেননি। এইকারণে তাঁকে আশাভঙ্গের যন্ত্রণায় ভুগতে হয়েছে। যাতে তাঁকে পুরুলিয়ায় স্বাস্থ্য উদ্ধার দূরে থাক,কলকাতায় ফেরার পাঁচ মাসের মধ্যে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করতে হয়েছে। এই পত্রিকার বিষয় নির্বাচন ও সমৃদ্ধ লেখনীতে বার বার মুগ্ধ হচ্ছি। মৃণাল সেনের জন্ম শতবর্ষে ওঁকে কেন্দ্র করে লেখাগুলো পড়ার শুরুতেই পেলাম চার্লি চ্যাপলিনকে নিয়ে ওঁর অপূর্ব অনুভূতির কথা। চলচ্চিত্র জগতের এক দিকপালকে অপর গুণী পরিচালকের অভাবনীয় স্মরণ। চার্লি চ্যাপলিন সম্পর্কে কতকিছু জানতে পারলাম। বিশ্বের সেরা কমেডিয়ানের জীবনের প্রেক্ষাপট, বাস্তবের শিক্ষা, ভাসমান অনিশ্চিত ছেলেবেলা যা শাণ দিয়ে হীরের দ্যুতিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল। এ সমস্ত দুর্লভ ভাণ্ডার পাঠকের সামনে হাজির হওয়া যেন এক রত্নের খনিকে প্রত্যক্ষ করা। অভিষেক ঘোষের 'মৃণাল সেনের কলকাতা-ট্রিলজি'তে চলচ্চিত্র পরিচালক মৃণাল সেনের সৃষ্টির এক মায়াবী ছবি পাই যেখানে চরিত্রদের হাত ধরে বাস্তব আমাদের সামনে এসে হাজির হয়,যে বাস্তব চিরন্তন। এরকম মার খাওয়া বা মার দেওয়া চরিত্রদের আমরা এখনও দেখতে পাই। লেখক সাবলীল ভাষায় সেই সমস্ত শিল্পকর্মের সুন্দর বিশ্লেষণ করেছেন। অনিন্দিতা পাত্র রচিত 'আকালের সন্ধানে ও মৃণাল সেন' এ নতুন করে 'আকালের সন্ধান' সিনেমাটা দেখতে পেলাম। তেতাল্লিশের মন্বন্তর দেখিনি,তবে সিনেমাটা দেখে সেটা উপলব্ধি করেছিলাম। স্মৃতিকে উসকে দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ লেখিকাকে। বিখ্যাত সঙ্গীতকার সলিল চৌধুরীর বয়ানে 'জীবন উজ্জীবন'এ ওঁর সঙ্গীত জীবনের ভিত্তি ও বেড়ে ওঠার আশ্চর্য ইতিহাস জানলাম। সুতপা ভট্টাচার্যের 'সুরসাধক সলিল চৌধুরী'তে ওঁর সম্পর্কে লেখিকার নিজস্ব অভিজ্ঞতা খুব সুন্দর ব্যক্ত হয়েছে। রম্যাণী গোস্বামী'বইগুলো সব যাবে কোথায়'তে গ্রন্থ ও গ্রন্থাগার নিয়ে ন্যয্য প্রশ্ন তুলেছেন। লেখিকার মুক্ত গ্রন্থাগারের অভিনব প্রস্তাব খুব ভাল লাগল। দীপককুমার বড় পণ্ডার 'শোলা-শিল্পের গ্রাম কেউটিয়া'থেকে শোলা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শিল্পীদের জীবনকথার সঙ্গে পরিচিত হলাম। যজ্ঞেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'মহর্ষির মহাবিদ্রোহকালীন মহাভ্রমণ'এ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্রহ্মচিন্তার অপরূপ উল্লেখ পাই। সংযুক্তা রায়ের নিবন্ধ 'সমাজ রাজনীতি ও অপরাধ' একটা অতি প্রয়োজনীয় আলোচ্য বিষয়। শিশুর ব্যক্তিতে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে সমাজ,পরিবার এগুলোকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না। এগুলো সহায়ক হলে শিশুর বেড়ে ওঠার পথ মসৃণ হয়।
গল্পকার বীথি করের 'উৎসব' ভাল লাগল। নান্দনিক চিত্রকথা বিভাগ অসাধারণ। সবগুলোই চোখকে টানছিল। সুশান্ত কুমার রায়ের 'লস্ট সোল' অনবদ্য কাজ। পিছিয়ে নেই কবিতার পাতাগুলো। আর্য মিত্র, মণিদীপা সান্যাল,গার্গী সেনগুপ্ত, শৌভিক গাঙ্গুলী, দ্রোণ মুখোপাধ্যায়, অমিতাভ সরকার, সুদীপ দে সরকার, রত্না ঘোষ, ভার্গবী,অভিলাষ সুরাই,সঙ্ঘমিত্রা ভট্টাচার্য ও রজত সান্যাল কবিতায় মুগ্ধ করলেন। প্রত্যেকের কবিতাই স্বকীয়তা ও আপন মহিমায় উজ্জ্বল।
বনপলাশির আধারেই 'ছোটদের অমলতাস ভিন্ন পরিসর দাবী করে। এত বৃহৎ একটা উৎসব সংখ্যার এমন সুন্দর অলংকরণ, নির্ভুল বিন্যাস যথেষ্ট প্রশংসনীয়। পৃষ্ঠার মানও উন্নত ও সংরক্ষণ যোগ্য। সর্বোপরি বলা যায় ক্ষুদ্র পত্রিকা বা এই লিটল ম্যাগ যে কোন বাণিজ্যিক পত্রিকাকে বলে বলে গোল দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।