প্রশান্ত গিরি
প্রশান্ত গিরি
পচা-মালতী
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই মোবাইলে মুখপুস্তিকায় চোখ রাখতেই পচার মেজাজ খানা গেল বিগড়ে | আজতো গোলাপ দিবস ! গত বছর মালতীকে গোলাপ দিতে গিয়ে ওর দাদার হাতে উত্তম মধ্যম খেয়ে বাড়ি ফিরে চুপ চাপ ঘুমিয়ে পড়েছিল | কপাল খারাপ, সকাল হতেই খবর চাউর, ছিঃ ছিঃ রব, বন্ধু মহলে প্রেস্টিজে গ্যামাক্সিন | টানা সাতদিন ঘর থেকে বেরোয়নি, মা মুখ-ঝামটে দিলে..."আহাঃ গো বীরপুরুষ আমার, শাজাহান হয়ে গেছিলেন পিরিত কর্তে, মাতায় তাজমহল ভেঙে পড়েনি এই রক্ষে | বলি বাপ্ টি একা মাঠে রুয়ে মরছে, একটু হাত লাগালে তো পারিস"| সে অপমান আজও তরতাজা, তবে পচা হাল ছাড়েনি ... হাল ছাড়বেও না, এর শেষ পচা দেখবেই ...|
একটু বেলা হলে পচা জিন্স গলিয়ে, রংবাহারী জামা চাপিয়ে ঘড়ি খানা পড়তে গিয়েই বিপত্তি, ঘড়ি তো বন্ধ! হোক গে ...কে আর ঘড়ি দেখছে, কব্জিতে বাঁধা থাকলেই কেল্লাফতে ...একটা ভারী ব্যাপার বটে, পার্সোনালিটি এক ঝটকায় মণ চারেক বেড়ে যায় |
গ্রামের এক কোনে মালতীদের বাড়ির সামনে ছোট্ট উঠোন, চারপাশ বাঁশের বেড়া দেওয়া, পুবদিকে একটা মস্ত আমড়া গাছ, ওকে ওই গাছেই বেঁধেছিল মালতীর দাদা, দাদা না ছাই, জ্যান্ত অসুর একটা | মালতীর মা ভানুমতী উঠোন ঝাঁট দিচ্ছে | পচার বুক ধক করে ওঠে ...ওকে দেখে যদি ঝাঁটা নিয়ে তাড়া করে ! কি হবে ? সে যা হবে হোক, প্রেমের জন্য লোকে কত কি করে, পচা না হয় দু-চার বাড়ি ঝাঁটা খেয়ে নেবে | তবে একটাই বাঁচোয়া, ওই অসুরটি নেই, মাস তিনেক হলো সুরাটে কাপড়ের কলে কাজ করতে গেছে | উঁকি ঝুঁকি দিয়ে মালতীর নাম গন্ধ কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না | এই ভাবে দাঁড়ানো টা ঠিক হবে না | মালতীর মা দেখতে পেলেই বাঁশ | আজকে মালতীর সাথে দেখা করতেই হবে, যা হোক আজকেই ফাইনাল, না হলে কালথেকে অন্য ইনিন্স শুরু |
" এই ছোঁড়া ...কি চাই তোর ? বেশ অনেকক্ষণ দেখছি উঁকি মারছিস "
পচা দেখলো স্বয়ং মা চন্ডী ঝ্যাঁটা হাতে পিছনে |
" না মানে ...এক জনকে খুঁজছিলাম "
" আমিও খুঁজছিলাম ...এক জনকে ..."
" মানে ..."
" মুখপুড়ি মালতী কাল পুকুরঘাটে বাসন মাজতে গিয়ে একটি কাঁসার বাটি জলে ফেলেছে, তুই পারবি তুলে আনতে ?"
" হাঁ ...আমি এক্ষুণি তুলে আনছি ..."
বলেই পচা পুকুরে নামতে উদ্যত হলো |
" আঃ ...মরণ, প্যান্ট জামা পরেই নামবি নাকি ...? দাঁড়া আমি এক খান গামছা আনি গে |"
পচা যেন স্বর্গ হাতে পেলো, হে ভগবান আমাকে শক্তি দাও, ডুব দিয়ে বাটি তুলতেই হবে, পানাপুকুরে ডুব দিয়ে ঠান্ডা লাগুক, নিমুনিয়া হোক, প্রাণ যায় যাক, এই সুযোগ | মালতী এই ডুব আমি তোকে উৎসর্গ করলাম, আমার ভালোবাসাকে উৎসর্গ করলাম, ডুব দিয়ে হয় বাটি উঠবে নয় আমার বডি উঠবে |
মালতী বাড়ি ফিরে দেখলো ওদের পানাপুকুর পাড়ে বেশ কিছু লোক জমেছে, ভানুমতী হাত নেড়ে নেড়ে, গলা খ্যাঁকরে বলছে ..." জল থেকে বাটি তুলবে, বুকে জোর নেই নেমেছে ডুব মারতে, ওরে কানার বেটা ওদিকে নয় আরো ডান দিকে গিয়ে ডুব মার্ ..." সঙ্গে হাসি, টিটকিরি ভেসে আসছে, মজা নিতে প্রতিবেশীরাও জড়ো হয়েছে |
মালতী হন হন করে বাড়িতে ঢুকলো, পিছন পিছন ভানুমতী |
"আচ্ছা মা...কি হচ্ছে এটা...?"
" ওই যে মুখপোড়া পানকৌড়ির মতো জলে ডুব মারছে "
মালতী প্রতিবাদ করে |
" ছিঃ ছিঃ ...মা,এটা ঠিক করলে ?"
" তো কি করবো ? পুজো ...? কোন ভদ্রলোকের ব্যাটা পরের বাড়িতে উঁকিমারে শুনি ? তোর দাদা থাকলে তো ওকে ওই জলেই চুবিয়ে মারতো "|
" এই অপরাধে যদি কাউকে মেরে ফেলতে চাও মা তবে আর কিছু বলার নেই ..."
মালতীর খুব লজ্জা করতে লাগলো, লঘুপাপে গুরুদণ্ড, মন থেকে মানতে পারছে না কিছুতেই | বড্ড খারাপ লাগে পচা দা থুড়ি সুবর্ণ দা'র জন্য, সাধা সিধে ছেলেটি যে মনে মনে ওকে ভালোবাসে তার প্রমাণ বেশ কয়েক বার পেয়েছে | গরিব চাষীর ছেলে, পড়াশুনোতেও অষ্টরম্ভা, তবে খুব সৎ ও পরোপকারী | মাঝে মাঝে ভাবে ওকে সব বুঝিয়ে বলে | দুনিয়াটা দেখনদার দের জিম্মায়, যে যত রং দেখাবে তার তত দাম, ভালো হৃদয় গুলো ব্যাথায় বধির, প্রেম অর্থ ছাড়া ব্যর্থ |
দুদিন হলো পচার জ্বর, পানাপুকুরে ডুব দিয়ে ওর সর্দি লেগেছে, পিরিত ব্যাটা দরজা দিয়ে সটান ভেগেছে ...| পচার মা গৌরীবালা উঠোনে বসে মৌরলা মাছ বাছছে আর ওর বাপ্ ভিজে জাল খানি শুকোতে দিচ্ছে |
" মাসিমা সুবর্ণ দা কোথায় ?"
" কে ...? ও ...তুমি ...! তুমিতো ভানুমতীর মেয়ে ...তাই না ...?
" সুবর্ণ দা কই ...?"
" কেন ...? তোমার দাদা পেটালো , তোমার মা জলে চোবালো , আর তুমি বাপু এসেই পড়েছ যখন এই বঁটি খানা নিয়ে ওর গলায় চালিয়ে দাও ..., "
" আমি একটু কথা বলতে চাই ..."
" যাও ...পাশের ঘরে পাঁকাল মাছের মতো শুয়ে আছে " বলে হাতের কাজ ফেলেরেখে মালতী কে নিয়ে ঘরে ঢুকলো গৌরীবালা | পচা তো অবাক ... হাঁ করেই আছে , এ কি স্বপ্ন নাকি সত্যি ? মালতী বললে ...
" শরীর কেমন ?"
" ভালো ..."
"ভালো না কচু, কেউ বললো পুকুরে ঝাঁপ দিতে আর অমনি ঝাঁপিয়ে পড়লে ? হাঁদারাম কোথাকার ! কই দাও আমার গোলাপ ? "
" ও তো শুকিয়ে গেছে ..."
"শরীর ভালো হলে অনেকগুলো গোলাপ চাই" বলে মুচকি হাসলো |
গৌরীবালা তো অবাক, এ মেয়ে বাড়ি বয়ে এসে বলে কি !
"আর যাবে আমার বাড়িতে উঁকি মারতে ?"
"না ..."
"সামনের মাসে দাদা বাড়ি আসবে, যাবে তো কথা বলতে ?"
"নাহঃ....এক দম নয়..."
"তবে আর বিয়ে করতে হবে না আমায়, শুয়ে থাকো চুপটি করে "
বলেই মুচকি হেসে মালতী হাতের কৌটো খানি গৌরীবালার হাতে দিয়ে বললে ...
" মা নিজের হাতে লেবুর রস মাখিয়ে ওলের বড়া বানিয়ে সুবর্ণ দার জন্য পাঠিয়েছে, জ্বর-মুখে খেতে বেশ লাগবে, জ্বরের খবর শুনে লজ্জায়, অনুতাপে পুড়ছে গো |"